অচেনা গলিতে রাজনীতি

গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা। গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন। ’৫২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০। একেকটি হিরণ্ময় সংখ্যা। কখনও কখনও সমালোচনা হয়েছে। সহিংসতার জন্যও দোষারোপ করেছেন কেউ কেউ। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির এক সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছিল মিছিলে-স্লোগানে মুখরিত রাজপথ। গণমানুষই ছিলেন রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা। যদিও তারা প্রতারিত হয়েছেন বারবার। সে ইতিহাস আলাদা।
তবে হালজমানার রাজনীতিতে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে এসেছিল ‘বিখ্যাত’ ওয়ান ইলেভেন। ক্ষমতার পরিবর্তনের পর একপর্যায়ে গ্রেপ্তার হন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। জরুরি জমানার দুই বছর দৃশ্যত রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। দুই নেত্রী গ্রেপ্তারের পর তাদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজপথে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। নেতাদের একটি বড় অংশ রাতের আঁধারে হাত মেলান। যদিও পর্যবেক্ষকদের কারও কারও ধারণা, ওয়ান ইলেভেন ছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফল।
দুই বছরের জরুরি শাসনের পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আবার চির চেনা দৃশ্য ফিরে আসে রাজনীতিতে। শুরুর দিকে সরকারবিরোধী কোন কর্মসূচি ছিল না বিএনপির। তবে দলটির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছুটে বেড়ান জেলা থেকে জেলায়। এসব সমাবেশে ঢল নামে মানুষের। রাজনীতির দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসতে শুরু করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর। কার্যত দলটির প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তালা দেয়া হয় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। দলটির যেকোন কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয়। গুলির ঘটনাও ঘটে। কোথাও কোথাও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা পুলিশের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। তবে বিএনপির মিছিল-সমাবেশে তখনও কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে অচেনারূপে নিয়ে যায় ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন। এ নির্বাচনের আগে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানালেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পর্যবেক্ষকরা অনেকেই এখন বলছেন, বেগম জিয়ার ওই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। দলের ভেতরে থাকা সরকার সংশ্লিষ্টরা তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছিল। ব্যাপক সহিংসতার পরও স্বল্প ভোটার উপস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। কিছুদিন নিজ বাসায় বালিবন্দি জীবন কাটান খালেদা জিয়া। পরে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ফের ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। পেট্রলবোমা আর ক্রসফায়ারে প্রাণ হারান বহু মানুষ। রাজনীতি কার্যত নেই। সরকারি দলের বেশির ভাগ কর্মসূচিই ঘরোয়া। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কে চালায় তা সবাই জানেন। এই দলটিও কোন মিছিল-সমাবেশে নেই। বিএনপি তো আসলে পল্টন কার্যালয় ছাড়া আর কোথাও নেই। মিছিল-সমাবেশের চিরায়ত রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে হারিয়েই গেছে।
কম গণতন্ত্র-বেশি উন্নয়ন- এমন স্লোগানে সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। এরইমধ্যে গত ২৮শে সেপ্টেম্বর ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকাণ্ড চারদিকে বিস্ময় তৈরি করে। সাইট ইন্টিলিজেন্সের বরাতে খবর বের হয়, আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। একেএকে সতর্কতা জারি করে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন পোশাক ক্রেতাদের একটি অংশ। বায়ার্স ফোরামের মিটিং স্থগিত হয়ে যায়। এরইমধ্যে আরও তিনটি ঘটনা ঘটে। জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যার শিকার হন রংপুরে। ঢাকায় পুলিশের এস আই খুনের পর হামলা হয় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি সভায়। ওই হামলায় এ পর্যন্ত দুজন নিহত হয়েছেন। এইসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যত বিএনপি-জামায়াতকেই দায়ী করা হচ্ছে। সিজার তাভেলা হত্যায় এখন পর্যন্ত চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কথিত বড়ভাইয়ের নির্দেশে তারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। বড়ভাই হিসেবে বিএনপি নেতা আবদুল কাইয়ুমের কথা বলা হয়েছে সরকারি মহল থেকে। আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, বিদেশী হত্যার নির্দেশ এসেছে লন্ডন থেকে।
রাজনীতির এই ব্লেইম গেমের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এখনও কমেনি। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাও কাটেনি। বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি দেশ কিছুদিন ধরেই সতর্ক বার্তা আপডেট করছে। বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্সের দাবিও রহস্য তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সরকার বারবার নাকচ করার পরও সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে তিনটি হামলায় আইএস জড়িত। পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতাকে ভালো চোখে দেখছে না সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতের সমালোচনা করেছেন। এ চার রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছেন। এ সাক্ষাৎ অবশ্য এখনও হয়নি। এরআগে তারা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ঢাকার বাতাসে ষড়যন্ত্র শব্দটিই এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত এ নিয়ে নানা আলোচনা। সরকারের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে এ কথাটি প্রতিদিনই কোন না কোন মন্ত্রী বলেন। দেশী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে বিএনপি-জামায়াতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী কারা এব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও স্পষ্ট করে কোন কিছু বলা হয়নি। যদিও সরকারের মন্ত্রীরা বারবার একটি বিষয়ে ইঙ্গিত করার চেষ্টা করছেন।
রাজনীতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে- একথাটি বহুদিন থেকেই প্রচলিত। পর্যবেক্ষকরা বলে আসছিলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে জঙ্গিরা। যদিও জঙ্গিবাদ নিয়ে রাষ্ট্রের দুই ধরনের নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতদিন জঙ্গিদের নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালানো হলেও এখন বিষয়টি ছোট করে দেখানোর প্রচেষ্টা চলছে। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ একটি বিপদসংকুল সময় পার করছে। যদিও এই দুর্যোগময় মুহূর্তে কোন দলই জনগণের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। বুধবার রাতেই একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের আলোচনায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, জনগণের কাছে যাওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজ হোক, কাল হোক জনগণের কাছে তো যেতেই হবে। আইয়ুব খানও শেষ পর্যন্ত জনগণের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
একের পর এক দুর্ঘটনায় যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে তখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা রাজনীতিতে চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, আরও বিএনপি নেতা দল ছাড়বেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয় কি-না তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে কোথায়ও যে গোলমাল চলছে তা নানা সূত্রেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের গুঞ্জন উঠেছে। বিশেষ করে এক শ্রমিক নেতা এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
রাজনীতিকে অচেনা গলি থেকে মাঠে নিয়ে আসার আলোচনাও রয়েছে। যদিও তা হবে একটি নির্দিষ্ট ছকে। হঠাৎ করেই বিরোধী নেতাদের কারও কারও বিরুদ্ধে মামলার গতি বেড়েছে। নিজ বাসাতেই আত্মগোপনে রয়েছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে রাজনীতি এখন এক জটিল সমীকরণের নাম।

No comments

Powered by Blogger.