হঠাৎ বাড়তি চাপে বিএনপি by সেলিম জাহিদ

অনেক দিন চুপচাপ থেকে হঠাৎ করেই গতকাল বৃহস্পতিবার রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যায় অভিযোগ উঠেছে বিএনপির দুই নেতা হাবিব-উন-নবী খান ও এম এ কাইয়ুমের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া কথিত ‘বড় ভাই’ হিসেবে সন্দেহের তালিকায় আরও অনেকে আছেন বলে সরকারের পক্ষ বক্তব্য দেওয়ায় আরও কোনো কোনো নেতাকে জড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি স্থানীয়পর্যায়ে ধরপাকড়ও বেড়েছে। এসব ঘটনায় হঠাৎ করেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বিএনপিতে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, দেড় মাস হলো বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের বাইরে আছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা অবসরে গেলেন। অন্য দুই নেতাকে বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত করার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। এই তিনটি ঘটনায় দলে দুশ্চিন্তা আছে। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে জিয়া পরিবারের প্রয়াত সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনায় রাজধানী ঢাকায় ঘটা করে একটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন, যার আয়োজক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই আহমেদ কামাল।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলছেন, এই মিলাদের আয়োজন নিয়েও কিছুটা সন্দেহ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিএনপির ভেতরে। বিরাজমান ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলের নেতা-কর্মীরা অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাঁরা এসব ঘটনার একটির সঙ্গে আরেকটির যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে সমশের মবিনের অবসরের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শাসক দলের পক্ষ থেকে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তাতে জল্পনা বেড়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, বিএনপির মধ্যে এখনো যাঁরা বিবেকবান মানুষ আছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, তাঁরা প্রত্যেকেই এই দল থেকে বেরিয়ে আসবেন। খালেদা জিয়া-তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে ঢেলে সাজাবেন।’
হানিফের এ বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সমশের মবিন এটা ‘ঝুঁকিপূর্ণ বক্তব্য’ বলে মন্তব্য করেন। বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। আমি কখনো ষড়যন্ত্রের শিকার হইনি, হবও না। সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যগত কারণে অবসরে গেছি।’ তিনি প্রোস্টেট, মাথা ঘোরা, পায়ে ও চোখের জটিল সমস্যায় ভুগছেন বলে জানান।
অবসরে যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত হয়নি। জানা গেছে, সমশের মবিন কিছুদিন ধরেই বন্ধুবান্ধব ও ঘনিষ্ঠদের কাছে রাজনীতি থেকে সরে আসার কথা বলছিলেন। তবে সমশের মবিন এও বলেন, অনেকের মতো তাঁর মনেও প্রশ্ন জাগে জিয়াউর রহমানের গঠিত বিএনপি এখন কি সেই নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী চলছে?
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সমশের মবিন সরাসরি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের উত্তরার বাসায় গিয়ে চিঠিটি গ্রহণ করিয়ে আনেন। সামরিক কর্মকর্তা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা, পরে বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এই নেতার হঠাৎ অবসর স্বাভাবিক মনে করছেন না বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে। তাঁদের ধারণা, কারাগারে থাকতে তাঁকে বিএনপি ভেঙে নতুন দলে যেতে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। সরকারের ইচ্ছানুযায়ী তা করা সম্ভব হবে না জেনে সমশের মবিন শেষ পর্যন্ত রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি সমশের মবিন চৌধুরীকে তাঁর বনানীর ডিওএইচএসের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা আছে। তিন মাস কারাভোগের পর গত ২২ মে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর থেকে সমশের মবিনকে বিএনপির কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি। এমনকি তিনি জামিনে মুক্তির পর রেওয়াজ অনুযায়ী দলীয় প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেননি। তখন থেকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে নানা গুঞ্জন ওঠে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এটাকে ‘অপ্রত্যাশিত কিছু নয়’ বলে মনে করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলে থাকলে ভালো হতো, থাকতে না পারলে কী করা যাবে। তিনি তো আমাদের মতো তৃণমূল রাজনীতি করেননি। অসুস্থ হলেও আমাদের মতো পারবেন না। জেলে ছিলেন, বের হয়ে আসার পর যোগাযোগও রাখতেন না। নেতা-কর্মীরা এর জন্য প্রস্তুত ছিল।’
নজরুল ইসলাম খান মনে করেন, সমশের মবিন চৌধুরী মিথ্যা মামলায় জেলে মানসিক চাপে ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য হয়তো এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এর মধ্যে ‘অন্য কোনো চিন্তা’ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
এদিকে ইতালির নাগরিক সিজার তাবেলা ও জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি খুনে দলের নেতা হাবিব-উন-নবী খান ও এম এ কাইয়ুমকে জড়ানোর ঘটনাকে সরকারের এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল বলে মনে করছে বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, এর মাধ্যমে সরকার বিএনপিকে বহির্বিশ্বে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছে। অপরদিকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনের বাইরে রাখার ছক থেকেই মিথ্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে। হাবিব-উন-নবী খান ও এম এ কাইয়ুম—দুজনেই আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী বলে জানান ওই নেতা।
মিলাদ নিয়ে গুঞ্জন: আগামী ৪ নভেম্বর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পরিবারের প্রয়াত সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে একটি মিলাদ মাহফিলের আয়োজন চলছে। এ নিয়ে বিএনপিতে নানা গুঞ্জন রয়েছে।
সূত্র জানায়, মিলাদে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও কার্ড পাঠানো হবে। জিয়াউর রহমানের একমাত্র জীবিত ভাই আহমেদ কামাল এই মিলাদের আয়োজক হলেও মূল পৃষ্ঠপোষকতা করছেন খালেদা জিয়ার দূরসম্পর্কের এক ভাগনে শরীফুল আলম (এস আলম ডন)।
আহমেদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরা (এস আলম) বলল, জিয়াউর রহমানসহ সবার জন্য করেন। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমার দ্বিমত নেই।’
ওরা কারা-জানতে চাইলে আহমেদ কামাল এই প্রতিবেদককে শরীফুল আলমের মুঠোফোন নম্বর দেন।
এ বিষয়ে শরীফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি (আহমেদ কামাল) খুব অসুস্থ ছিলেন। হাসপাতাল থেকে এসে আমাকে বললেন, মৃত্যুর আগে বাবা-মায়ের জন্য একটা মিলাদ দিতে চাই। আমি বললাম, তা হলে জিয়াউর রহমানসহ পরিবারের সবার জন্য করেন। বিএনপির সবাইকে দাওয়াত করেন।’ দাওয়াতি মেহমানের সংখ্যা পাঁচ-ছয় শ হতে পারে বলে তিনি ধারণা দেন।
শরীফুল আলম বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) খালা লিলিমন বিবি আমার দাদি। সেই সূত্রে আমি ওনার ভাগনে। কামাল সাহেবকে আমি চাচা ডাকি, তিনি আমাকে ভাতিজা ডাকেন।’ জানা গেছে, শরীফ একজন ফল ব্যবসায়ী। বিদেশ থেকে ফল আমদানি করেন। তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম টোটাল মার্কেটিং।
আহমেদ কামাল বলেন, তাঁরা পাঁচ ভাই। তিনি সবার ছোট। সবার বড় রেজাউর রহমান, এরপর জিয়াউর রহমান, মিজানুর রহমান ও খলিলুর রহমান। চারজনই মারা গেছেন। তার আগে মারা গেছেন বাবা মনসুর রহমান ও মা জাহানারা খাতুন। মেজো ভাইয়ের ছেলে আরাফাত রহমান কোকোও সম্প্রতি মারা গেছেন।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অবসরে যাওয়া আহমেদ কামাল অবিবাহিত। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর গণমাধ্যমকে দেওয়া তাঁর কিছু মন্তব্য জিয়া পরিবারের সদস্যদের অস্বস্তিতে ফিলেছিল। এরশাদ সরকারের সময়ে একবার তাঁকে সামনে এনে নতুন দল গঠন করার চেষ্টা হয়েছিল বলে বিএনপির নেতারা বলছেন।
হঠাৎ এ ধরনের আয়োজনের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, জানতে চাইলে আহমেদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘না, না। এখনো সে পর্যায়ে আসিনি। ভবিষ্যতে দেখা যাক।’ তা হলে কি সে ধরনের সম্ভাবনা আছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘শরীর ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান মিলাদের দাওয়াত পাননি বলে জানান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কথা নেই, বার্তা নেই, এত দিন পর মিলাদের দরকার হলো কেন? তাও আবার হল ভাড়া করে। সরকার তো অনেক কিছুই করার চেষ্টা করছে। এর পেছনে কারা আছে, নেতা-কর্মীদের সন্দেহ তো হতেই পারে।’

No comments

Powered by Blogger.