মানুষের বন্দিশালায় পাখিদের আশ্রয় by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

থাকে ওরা কারাগারে, তবে বন্দী নয়। সকালে বাইরে বেরোয়, বিকেলে ফেরে। ওদেরই কূজনে মুখরিত কারাগার। পায়ে ওদের শিকল পরাবে কে?
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের গাছে গাছে এখন অসংখ্য পাখি। সবই শামুকখোল। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পাখিরা শেষ পর্যন্ত কারাগারকেই বেছে নিয়েছে। এখানে তাদের ধরার কেউ নেই। বিরক্ত করারও কেউ নেই। গত তিন-চার বছরে কারাগারের গাছগুলোতে এই পাখির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সংখ্যা বাড়তে বাড়তে তারা কারাগারের বাইরের কয়েকটি গাছেও ছড়িয়ে পড়েছে।
কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরের গাছে পাখিদের এই মাতামাতি অনায়াসে দেখা যায়। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব পাশে রয়েছে কারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কারাগারের ভেতরে কয়েকটি রেইনট্রিগাছের চূড়া চোখে পড়ে। তাকালে গাছে কোনো পাতা দেখা যাবে না, দেখা যাবে পাখি আর পাখি। মনের আনন্দে ওদের অকারণ ওড়াউড়ি বেশ উপভোগ্য।
কারা বিদ্যালয়ের সামনে একটি তেঁতুলগাছ, একটি মেহগনিসহ বেশ কয়েকটি গাছে একইভাবে বসে আছে পাখি। তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। ছবির মতো মনে হয়। একসঙ্গে এত পাখি খুব কমই দেখা যায়।
২৩ অক্টোবর সকালে এই কারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পাখি দেখছিলেন রাজশাহী শহরের কবি আমিনা আনসারী। তিনি বলেন, ‘চারদিকে যেভাবে পাখিদের নিরাপদ আবাস ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে পাখিরা দাঁড়ানোর জায়গা পাচ্ছে না। মানুষের অত্যাচারে এলাকা ছেড়ে পালাতে পালাতে পাখিরা শেষ পর্যন্ত মানুষের বন্দিশালায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। কী মিরাকল! মানুষ যেখানে বন্দী, পাখি সেখানে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। তারা সেখানে নিরাপদ। এই দৃশ্য দেখে আমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত।’
পাখি দেখছিলেন নগরের ছোটবনগ্রাম ইউসেপ স্কুলের শিক্ষক মাসুদ রানা। তিনি বললেন, শহরের যান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যেও পাখিরা ঠিকই তাদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করেছে। শহরের মধ্যে এ রকম নজরকাড়া দৃশ্য আর নেই। তিনি বলেন, পাখিদের সুবিধার্থে কারা বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা উচিত। বিদ্যালয়ের পেছনে কারাগারের জমিতে কাজ করছিলেন একজন দিনমজুর। তিনি বললেন, চার বছর ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন। তিনি খেয়াল করেছেন, জুন মাসের দিকে এই পাখিরা আসে।
জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক শফিকুল ইসলাম খান বলেন, কারাগারের ভেতর যে এলাকায় আগে গোয়ালঘর ছিল—মহিষ পোষা হতো, এখন সেখানে কেঁচো সার ও মাশরুম চাষ করা হয়। ওপরে চালা রয়েছে। সেখানে বন্দীদের চলাফেরা কম। প্রয়োজনে যখন তাঁরা যান, তখন ছাতা ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, এইটুকু অসুবিধা তারা পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়ের স্বার্থে মেনে নিয়েছেন। তা ছাড়া বন্দীদেরও নির্দেশ দেওয়া রয়েছে—কেউ তাদের বিরক্ত করবে না। গত বছরের চেয়ে এবার আরও বেশি পাখি এসেছে এখানে। সন্ধ্যার আগে সব পাখি যখন গাছে এসে বসে, তখন পরিবেশটা আরও দর্শনীয় হয়ে ওঠে বলে জানালেন এই জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে ও বাইরের গাছগুলোয় ঠাঁই নিয়েছে শামুকখোল পাখি l ছবি: প্রথম আলো

No comments

Powered by Blogger.