অদম্য মেধাবীদের অপরাজেয় দেশ by আনিসুল হক

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবীদের
সংবর্ধনা আর বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে মেধাবীরা
বাংলাদেশ নিয়ে আমার আশা যায় না। ২০ বছর পরের বাংলাদেশ যে একটা আলোকোজ্জ্বল ঝলমলে দেশ হবে, এই বিষয়ে আমি শতকরা ৯৯ ভাগ নিশ্চিত। আর আমার এই আশার মূলে আছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এক এক জন মানুষ কী কাণ্ডটাই না করছেন!
৮০-৮৫ জন কিশোর-তরুণ এসেছিল গতকাল। ঢাকার কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনের ১০ তলার মিলনায়তনে। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবীদের সংবর্ধনা আর বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল তারা। তারা এসেছে দেশের নানা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। কেউ সাতক্ষীরা থেকে, কেউ নাচোল থেকে, কেউবা এসেছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী থেকে। তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়। বাবা অসুস্থ। মা এ–বাড়ি ও–বাড়ি কাজ করেন। মেয়ের পড়াশোনা বুঝি বন্ধ হয়ে যায়। মেয়ে ভালো ছাত্রী। ক্লাস ফাইভের পরে উপবৃত্তি পায়। বন্ধুরা সহযোগিতা করে। নিজে টিউশনি শুরু করে। সেই মেয়ে মাধ্যমিকে পেয়েছে জিপিএ-৫।
কিংবা বাবা জেলে। পড়ার খরচ জোগাড় করতে ছেলে চলে যায় নদীতে। মাছ ধরে। দিনের অনেকটা সময় তার কাটে নদীতে। তারপরও ছেলে মাধ্যমিকে পায় জিপিএ-৫।
একে তো দারিদ্র্য, তার মধ্যে দুই চোখে আলো নেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সে বলে, প্রথমে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলাম না। পরে বুঝতে পারলাম পড়াশোনার মূল্য। কষ্ট করে হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যাই। সে বলে, প্রতিবন্ধীদের পড়ার খরচ অনেক বেশি লাগে।
এরা হার না-মানা অদম্য মেধাবী। ৫৫ জন এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের বৃত্তি দিল ব্র্যাক ব্যাংক এবং প্রথম আলো ট্রাস্ট। আর দুই বছর আগে থেকে বৃত্তি পেয়ে আসছে, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় আবারও জিপিএ-৫ পেল, এমন ৩০ জনকে আবারও বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
এই ছেলেমেয়েরা কেবল মেধাবী নয়, দুর্দমও। এবং প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। এস আই টুটুল যখন মঞ্চে উঠলেন, তারা চিৎকার করে উঠল—ধ্রুবতারা, ধ্রুবতারা। ধ্রুবতারা নামের গানটা ধরলেন টুটুল, সবাই তাঁর সঙ্গে গেয়ে উঠল একযোগে।
শিক্ষা এদের পাল্টে দিয়েছে। একজনের বাবা দিনমজুর, সে মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে আবারও জিপিএ-৫ পেয়েছে উচ্চমাধ্যমিকে, ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে বুয়েটে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষের সামনে স্পষ্ট সুন্দর ভঙ্গিমায় কথা বলল, একটুও জড়তা নেই, একটু ভয়ও এরা পায় না মঞ্চকে, মাইক্রোফোনকে!
বাংলাদেশের মানুষের এই অবিনাশী আত্মায় আস্থা রাখতেই হয়। বটগাছের বীজ যেমন পাকা ভবনের দেয়ালে পড়লেও অঙ্কুরিত হয়, মাথা তুলে দাঁড়ায়, বাংলাদেশের মানুষও তেমনি, একটুখানি পরিসর দিলেই ডালপালা মেলে ধরতে পারে। একটুখানি শিক্ষা, একটুখানি প্রশিক্ষণ। তরুণ ক্রিকেটার মুস্তাফিজকে যেমন তৈরি করে সাতক্ষীরার সুন্দরবন ক্রিকেট একাডেমি। নামেই একাডেমি। আসলে তো একটা ক্রিকেট ক্লাব, মফস্বল শহরে যেমন হয়! কিন্তু বিকেএসপির মতো প্রতিষ্ঠান কত খেলোয়াড়ই না তৈরি করছে।
আমরা কয়েকজন অদম্য মেধাবীর কাহিনি মঞ্চের মাইক্রোফোনে শুনি। একটা বিষয় অভিন্ন: স্কুলের বৃত্তি, উপবৃত্তি এদের অনেকটাই কাজে লেগেছে।
আমরা আমাদের বর্তমান নিয়ে তৃপ্ত নই, কিন্তু বর্তমানের ১০০টা সূচক আমাদের আশাবাদী করে তোলে ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ ভালো হবে বলে বর্তমানের লড়াই থেমে থাকবে না বাংলাদেশের কোটি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পায়। ২০ বছর পরে বাংলাদেশের কৃষক হবে শিক্ষিত কৃষক, শ্রমিক হবে শিক্ষিত শ্রমিক।
সেই বাংলাদেশ কী অপরূপ হয়ে উঠবে!
এখনই আমাদের কৃষকেরা আশ্চর্য রকমের কাণ্ডকারখানা করে দেখিয়েছেন। খাদ্য উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। ডিম, দুধ, মাছ, সবজি চাষে বিপ্লব ঘটে গেছে। এখন ফলও ফলছে বেশি। বিপ্লব ঘটে গেছে গার্মেন্টস শিল্পে। বিপ্লব ঘটে গেছে অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রাপ্তিতে। এই মানুষগুলোকে একটুখানি প্রশিক্ষণ দিলে তারা হয়ে উঠবে দক্ষ শ্রমিক। এখন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি বিদেশে আছে। ২০ বছর পরে সাধারণ হিসেবেই প্রবাসীর সংখ্যা হবে চার কোটি। টাকার কোনো অভাব থাকবে না। কেউ নিরক্ষর থাকবে না। নতুন প্রযুক্তি, চিন্তা, জীবনধারা গ্রহণে বাংলাদেশের মানুষের কোনো তুলনা হয় না। এই দেশের মানুষের দুই গুণ: সহিষ্ণুতা আর গ্রহিষ্ণুতা। তারা সইতে পারে, আর গ্রহণ করতে পারে।
কাজেই ১০ বছরের মধ্যেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হব। ২০ বছর পরে বাংলাদেশ হবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ, শতভাগ শিক্ষিত মানুষের দেশ। সেই দেশে সুশাসন আসতে বাধ্য। পুঁজি নিজের স্বার্থে নিজেকে পাহারা দেবে, তখন তার দরকার হবে আইনের শাসন, দরকার হবে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার, দরকার হবে আইনশৃঙ্খলা। ওই দেশে যানজট থাকতেই পারবে না। কারণ, তখন আমাদের সামর্থ্য থাকবে, অর্থনৈতিক সামর্থ্য আর প্রযুক্তিগত সামর্থ্য। বড়লোকেরা গাড়ি নিয়ে বেরোতে চাইলে তাদের তো রাস্তাও লাগবে।
দুটো দুশ্চিন্তা অবশ্যই খুবই বাস্তব। একটা হলো, শিক্ষার মান। গতকালের অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও জোর দিলেন মানসম্মত শিক্ষার ওপর।
আরেকটা বিষয় হলো, পরিবেশের ওপরে উন্নয়নের বিরূপ প্রতিক্রিয়া। আমাদের জমি কম, মানুষ বেশি। উন্নয়নের পাগলা ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে বন-জঙ্গল-নদী-মাটি লন্ডভন্ড করে ফেলে। কোনো নীতি-নৈতিকতা সুবচন সে মানতে চায় না।
বিদেশের মাটিতে ২০ বছর আগে যাওয়া আমাদের মানুষেরা এখন ভালো করছেন। তাঁদের নিজেদের বাড়ি হয়েছে, যিনি জীবন শুরু করেছিলেন হোটেলে কাজ করার মাধ্যমে, আজ তিনি নিজেই হোটেলের মালিক। তেমনিভাবে গ্রামগঞ্জে মানুষের মনে তৈরি হয়েছে আশার জমিন।
সম্প্রতি আমার এক বন্ধু গিয়েছিল উত্তরবঙ্গ সফরে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের মধ্যে ইতিবাচক কী দেখেছ? সে বলেছে, মানুষের মনে কোনো অভিযোগ নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, ভালো আছি। এর কারণ, সবার ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, সবাই দিনবদলের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে।
তার মানে এই নয় যে খারাপ কিছু ঘটছে না। এক হাজারটা খারাপের উদাহরণ আমরা দিতে পারব। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সমস্যা থেকে শুরু করে মাদকের সমস্যা। মানুষ যে বিপজ্জনক পথে বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টায় মারা পড়ছে, সেটাই তো বলে দেয়, দেশের অবস্থা এখনো অত ভালো নয়। কিন্তু নেতির মধ্যেও আমি ইতি খুঁজে পাই। এই যে মানুষের মরিয়া প্রচেষ্টা, নিজের ভাগ্য বদলের, পরিবারের অবস্থা উন্নয়নের, সেখানেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সাফল্যের বীজ। এখানেই আসে সুকান্তের কবিতা, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা বাঁচব। সারাটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে আমরা জাতির ভাগ্যের বদল ঘটাব। ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি, তার কারণ স্নেহার্দ্র বঙ্গভূমি তার সন্তানদের চিরশিশু করে আঁচলে বেঁধে রাখে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে লড়াই করে বাঁচে না। এখনকার বাংলাদেশের মানুষেরা সেই দুর্নাম ঘুচিয়েছে।
এখন বাংলাদেশ হচ্ছে সম্ভাবনার দেশ। একটা মানুষ একটা অনন্ত সম্ভাবনা। ১৬ কোটি মানুষ ১৬ কোটি সম্ভাবনা।
আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে মোম আছে। সলতে আছে। সলতেটায় অগ্নিসংযোগ করার অপেক্ষা মাত্র। শিক্ষা হলো সেই আগুন। একেকটা হৃদয় আলোক শিখা হয়ে জ্বলে উঠবে। আর একটা মোমবাতি থেকে জ্বালানো যায় ১০০টা মোমবাতি। একটা হৃদয় আলোকিত হলে তার প্রভাবে আলোকিত হবে তার চারপাশ।
আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই, সারা বাংলাদেশের কোটি হৃদয়ে আলো জ্বলছে। অনন্ত নক্ষত্রবীথির মতো আলোয় আলোয় ঝকমক করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। এই দেশের হার না-মানা মানুষেরা আগুনের পরশমণি প্রজ্বলিত করেছে টেকনাফে, তেঁতুলিয়ায়, রূপসায়, পাথুরিয়ায়।
আমরা আমাদের বর্তমান নিয়ে তৃপ্ত নই, কিন্তু বর্তমানের ১০০টা সূচক আমাদের আশাবাদী করে তোলে ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ ভালো হবে বলে বর্তমানের লড়াই থেমে থাকবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মধ্যম আয়ের দেশ আর স্বল্পোন্নত দেশের মানুষের লড়াইয়ের রকমটা এক হয় না। এখন আমাদের লড়াই সুশাসনের জন্য, উন্নত মানের জন্য। কবিকে আরেকটু ভালো কবিতা লিখতে হবে, শিল্পীকে আরেকটু ভালো শিল্প রচনা করতে হবে। শিক্ষা আরেকটু মানসম্পন্ন করতে হবে, চিকিৎসাব্যবস্থা, যোগাযোগব্যবস্থা, মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা তথা গভর্নেন্স আরেকটু উন্নত করতে পারতে হবে।
অনেক দিন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ উত্তাল সমুদ্র ভ্রমণ শেষে আমরা দূরে দেখছি সবুজ দ্বীপ। মারায়া কেরির একটা গান আছে, দেয়ার ক্যান বি মিরাকলস হোয়েন ইউ বিলিভ। তাতে বলা হয়েছে, বহু রাত প্রার্থনা করেছি, বৃথাই, কোনো আশা ছিল না, কিন্তু এখন আমরা জানি আশা আছে। বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমরা পারব, এই কথা ভেবে আমরা বিশ্বাস রেখে পথ হেঁটেছি, এখন আমরা প্রমাণ পাচ্ছি যে আমরা পারব। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর গুরু উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে যা বলেছিলেন, সেটা আমি এই কলামে অনেকবার বলেছি, আবারও বলি—মানুষের পরাজয় মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি। মানুষের পরাজয় নেই, তা এ জন্য নয় যে তার ভাষা আছে, তা এ জন্য যে তার আত্মা আছে।
বাংলাদেশের মানুষের আছে অপরাজেয় আত্মা, বাংলাদেশের মানুষেরও পরাজয় নেই। ৮০ জনের বেশি অদম্য মেধাবীর সঙ্গে মাহমুদুজ্জামান বাবু যখন বাংলার গান গাইছিলেন, যখন মেধাবীরা এস আই টুটুলের ধ্রুবতারা গাইছিল একযোগে, তখন আমিও দেখতে পাচ্ছিলাম একটা ধ্রুবতারা—ভালোবাসার ধ্রুবতারা—বাংলাদেশের জয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.