কাশ্মীর - ভারত পাকিস্তান যেখানে মুখোমুখি

কাশ্মীর সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যা। এটা অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ যেটা ইংরেজরা আমাদের ভেতরে সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯ সালগুলোর রক্তের দাগ ধরে যদি আমরা পেছনে ফিরে যাই তাহলে দেখতে পাবো এই সকল যুদ্ধের সূচনা হয়েছে এই কাশ্মীর দ্বন্দ থেকেই। সাহিত্যিকেরা যে ভূখন্ডকে পৃথিবীর স্বর্গ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন সেই কাশ্মীর আজ এক অঘোষিত যুদ্ধের ময়দান। এই ব্যাপারে লেখার সময় আমাকে সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন কোন বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর একপেশে সমালোচনা কিংবা সমর্থন না হয়ে যায়। এ সম্পর্কে আমার নিজের জানাশোনাও খুব বেশী নয়।
জম্মু ও কাশ্মীর হল ভারতের একটি রাজ্য। এই রাজ্যটি প্রধানতহিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। এই রাজ্যের দক্ষিণে ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাবরাজ্যদুটি অবস্থিত। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উত্তরে ও পূর্বে গণচীন অবস্থিত। এই রাজ্যেরপশ্চিমে ও উত্তরপশ্চিমে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে কাশ্মীরের পাকিস্তান-শাসিত অংশ আজাদকাশ্মীর ও গিলগিট-বালটিস্তান অবস্থিত।
বর্তমান জম্মু ও কাশ্মীর ভূখণ্ডটি অতীতে কাশ্মীর ও জম্মুদেশীয় রাজ্যের অধীনস্থ ছিল। এই রাজ্যের শাসকেরা ঐতিহাসিক বৃহত্তর কাশ্মীর অঞ্চল শাসনকরতেন। এখন কাশ্মীর অঞ্চলের মালিকানা নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও গণচীনের মধ্যে বিবাদরয়েছে। এই বিবাদের জেরে জাতিসংঘ ও অন্যান্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় জম্মুও কাশ্মীর রাজ্যটি "ভারত-অধিকৃত কাশ্মীর" বা "ভারত-শাসিত কাশ্মীর"নামে পরিচিত। অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসনাধীনে থাকা অংশটি ভারতে "পাকিস্তান-অধিকৃতকাশ্মীর" এবং পাকিস্তানে "আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর" নামে পরিচিত।
জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখ - এই তিন অঞ্চল নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি গঠিত। শ্রীনগর এই রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং জম্মুশীতকালীন রাজধানী। কাশ্মীর উপত্যকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। জম্মু অঞ্চলে অনেক হিন্দু মন্দির থাকায় এটি হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। লাদাখ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলটি "ছোটো তিব্বত" নামেও পরিচিত।
১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মীরের রাজা হন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের শাসক। কাশ্মীরের মুসলিম প্রধান অংশের নাম কাশ্মীর এবং হিন্দু প্রধান অংশের নাম জম্মু। তবে দুই অংশের মোট জনসংখ্যার বিবেচনায় মুসলিম প্রধান হলেও এর শাসক ছিলেন হিন্দু যাকে বলা হতো ‘ডোগরা রাজা’। ১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাজনের অন্যতম শর্ত ছিল, ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন,অথবা তাঁরা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। হরি সিং ভারত বা পাকিস্তান এর কোনোটিতেই যোগদান না করে রাজা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। এটি পাকিস্তান মেনে নিলেও ভারত মেনে নিল না। ১৯৪৭ সালের ২৫ অক্টোবর হরিসিং কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। ২৭ অক্টোবর তা ভারতের গভর্নর-জেনারেল কর্তৃক অনুমোদিত হয়। কথিত আছে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বান্ধবী লেডিমাউন্ট ব্যাটেনের প্রভাবে ও ভারতের কূটকৌশলে শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
চুক্তি সই হওয়ার পর, ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশকরে। ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর পাকিস্তান-সমর্থিত আদিবাসীরা কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে। ভারতেরসৈন্য নামানোর সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানও কাশ্মীরে সৈন্য প্রেরণ করল এবং ভারতীয় সৈন্যদেরহটিয়ে দিয়ে কাশ্মীরের অংশবিশেষ দখল করল।
বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হলে জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তানকে তাদের অধিকৃত এলাকা খালি করে দিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের প্রস্তাব দেয়। ভারত প্রথমে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদ ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিলে ভারত গণভোটের বিপক্ষে মত দেয়। ভারত ও পাকিস্তানে জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধবিরতি তত্ত্বাবধানে আসে। এই গোষ্ঠীর কাজ ছিল, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখা ও তদন্তের রিপোর্ট প্রত্যেক পক্ষ ও জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে জমা দেওয়া। যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে কাশ্মীর থেকে উভয় পক্ষের সেনা প্রত্যাহার ও গণভোটের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ভারত গণভোটে অসম্মত হয় এবং পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহারে অসম্মত হয়। ভারত নিম্নোক্ত কারণে গণভোটে সম্মত হয়নি।
১. ভারতের মতে, ১৯৫২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদ ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছিল এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনেও কাশ্মীরিরা ভোট দিয়েছিলেন। তাই আলাদা করে গণভোটের প্রয়োজন নেই।
২. ১৯৪৮-৪৯ সালে জাতিসংঘের দেওয়া প্রস্তাব খাটবে না। কারণ মূল ভূখণ্ডের চরিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। পাকিস্তান তাদের অধিকৃত কাশ্মীরের কিছু অংশ চীনকে দিয়ে দিয়েছিল।
৩. গণভোটের বিপক্ষে ভারতের আরেকটি যুক্তি ছিল, পাকিস্তান তাদের অধিকৃত কাশ্মীরে অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের বাস করার অনুমতি দিয়েছে।
৪. তাছাড়া ভারতের মতে, পাকিস্তান-সমর্থিত অনুপ্রবেশকারীরা কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ২৫০,০০০ কাশ্মীরি পণ্ডিতকে বিতাড়িত করায় ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। এছাড়াও ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান
১৯৪৮ সালের ১৩ অগস্টের জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে কাশ্মীর অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করেনি।
১৯৪৭- ১৯৪৮ সালের দিকে এই দুই দেশের মাঝে কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টিতে জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করে। এই মধ্যস্থতা ভারতমেনে না নিলে ১৯৬৫ সালে যুদ্ধ শুরু হয় । ১৯৬৬ সালের ১০ ই জানুয়ারী বর্তমান রাশিয়া তাসখন্দচুক্তির মাধ্যমে সে যুদ্ধের নিষ্পত্তি ঘটাতে সক্ষম হলেও ১৯৭১ সালে আবার তারা যুদ্ধেজড়িয়ে পড়ে।
এ সুযোগে সোভিয়েত সমাজ আফগানদের উপর হস্তক্ষেপ করলেপাকিস্তান আফগানদের সহযোগিতা করলে এ সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সাথে একটি ভাল সম্পর্কেরভিত্তিতে ভারতকে পারমানবিক অস্ত্র নির্মানে সহযোগিতা করে। পাকিস্তান একই সুযোগে চীনেরসহযোগিতায় পারমানবিক অস্ত্রেও টেক্কা দিতে সক্ষম হয়।
১৯৬৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলো, ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কাশ্মীরিদের ভাগ্যে আরও অমানিশার অন্ধকার নেমে এলো। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য ফিরে পাওয়া এবং পশ্চিম সীমান্তে ভারতের দখলীকৃত ভূমি ফিরিয়ে দেয়ার শর্তে শিমলা চুক্তিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টু কাশ্মীর সমস্যাকে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা বলে মেনে নিলেন। ১৯৭২সালে পাক-ভারত সমস্যা সমাধান কল্পে সিমলা চুক্তি হয় এই চুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়যে ভারত পাকিস্তানের মাঝে বিবাদমান সমস্যাগুলো তারা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করবে। কারগীলসীমান্ত নিয়েও দুই দেশের সম্পর্ক দিনে দিনে অবনতির দিকে চলে এর অর্থ দাঁড়াল এই যে, জাতিসংঘ স্বীকৃত গণভোট অনুষ্ঠানের দায়বদ্ধতা থেকে ভারত মুক্ত হয়ে গেল। কাশ্মীর নিয়ে এর পরেও ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ হয়েছে কারগিল যুদ্ধে। পাকিস্তান সৈন্য নামিয়েও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে আমেরিকার চাপে। শুধু তাই নয়, এর পর থেকে কাশ্মীর প্রসঙ্গে আর কোনো কথাবার্তাও বলছে না পাকিস্তান।
এদিকে কাশ্মীরের জনগণও কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের বিষয়ে ত্রিধা বিভক্ত। হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং দিল্লির আনুকূল্যপ্রাপ্ত মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র অংশ কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে। একটি অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। কিন্তু কাশ্মীরের বৃহত্ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কাশ্মীরের স্বাধীনতা চায়। তারা চায় গণভোটের মাধ্যমেই কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারিত হোক। কিন্তু দিল্লি কাশ্মীরকে এখন তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশই মনে করে। এমনকি ‘ডোগরা রাজা’ এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিম নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাশ্মীরের জন্য বিশেষ ধরনের স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা প্রদানের পরিবর্তে সেখানে কঠোরতম কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ চালু রেখেছে তারা। কাশ্মীরের মতো একটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বর্তমানে ৫ লাখের অধিক সৈন্য রয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ ইতোমধ্যেই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে। প্রতিদিনই আরও তাজা প্রাণ ঝরছে। শত শত তরুণী নারী প্রতিদিন ভারতীয় সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে। দিনের পর দিন সান্ধ্য আইন চলছে। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। দোকানপাট বন্ধ। মানুষের আয়-রোজগারও বন্ধ। মিছিল-মিটিং, বিক্ষোভ সবই কঠোরহস্তে দমন করা হচ্ছে। স্বাধীনতা দূরে থাকুক, বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সংগ্রাম করাই তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে একটি স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার শুধু স্বাধীনতা চাওয়ার অপরাধে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অথচ সমগ্র বিশ্ব নিশ্চুপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ভারত-পাকিস্তান উভয়ে সম্মত না হলে তারা কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের বিষয়ে নাক গলাবে না। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ ইউরোপ ও কাশ্মীরের বিষয়ে টু-শব্দটি করে না। যদিও তারা দাবি করে বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা তাদেরই অবদান। তারা ইউরোপের কৌলিন্য বজায় রাখার জন্য এতটাই তত্পর যে, মুসলিম দেশ হওয়ায় তারা তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্থান দিতেও প্রস্তুত নয়। বর্তমান বিশ্ব যাদের প্রভাবে, অর্থে এবং শক্তিতে প্রভাবিত, তাদের কথা না হয় বাদই দেয়া যাক। এশিয়া এবং আফ্রিকার তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বই বা কি করছে? চীন নীরবে তাদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে। কৌশলগত কারণে এই মুহূর্তে ভারতের বিরাগভাজন হতে চায় না তারা। আর শত কোটি লোকের দেশ ভারত এ অঞ্চলের নতুন মোড়ল বনে গেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়ার শুধু অপেক্ষা। এমন দাপুটে ভারতের প্রতিবেশীরা তো ভারতের ভয়ে অস্থির। প্রত্যেকেরই ভারতের সঙ্গে নিজস্ব সমস্যা থাকলেও সে সব কথা বলারই সাহস পাচ্ছে না। বিশেষ করে মুসলিম প্রধান পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ভারতভীতি ছাড়াও অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। পাশ্চাত্যের তল্পীবাহক শাসকগোষ্ঠী সেনাবাহিনী সব সময় পাশ্চাত্য তথা আমেরিকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। পরমুখাপেক্ষী নীতির কারণে আজও তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ আর্থিক-সামাজিক সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক বিবেচনায় অনেক এগিয়ে গেলেও ভারতপন্থী এবং ভারত বিরোধী তীব্র বিভাজন থাকায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয়ই কাশ্মীরের ব্যাপারে নির্লিপ্ত।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোও কাশ্মীরের অব্যাহত ও ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো দেখেও না দেখার ভান করছে।
কারণগুলো হচ্ছে :
কাশ্মীরের পতাকা
১. কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীরা মুসলমান।
২. তারা অমুসলিম/হিন্দুপ্রধান ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে।
৩. কিছু কিছু স্বাধীনতাকামী গ্রুপ ও সংগঠন পার্শ্ববর্তী মুসলিম প্রধান পাকিস্তান রাষ্ট্রের ও সে দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে।
৪. বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একজন মুসলিম বিদ্রোহীকে হত্যা অথবা একজন মুসলিম নারীকে ধর্ষণ, একজন ইহুদি, খ্রিস্টান ও বর্ণহিন্দু বিদ্রোহী অথবা নারী ধর্ষণের অপরাধের সমান নয়। আমেরিকা এবং ইউরোপীয়দের বিবেচনায় ইসরাইল এবং ভারত যা কিছুই করে তার সবই হালাল! একই কাজ আরব ও মুসলমানরা করলে তা হয় অপরাধ!
৫. মুসলমানদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিলে বা ভেঙে দিলে রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি কবিতায় বর্ণিত অবস্থার মতো তা তেমন কোনো ক্ষতির ব্যাপার হয় না।
৬. ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ হলেও ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের যুদ্ধ সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়!
তবে আশার কথা, ভারতের অরুন্ধতী রায় সে দেশের অধিকার হারা নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার রক্ষায় এবং জীবন মান উন্নয়নে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত এই মানবাধিকার নেত্রীকেও ভারতের শাসক শ্রেণী ও বর্ণবাদীদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে বার বার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতারের ভয় দেখানো হচ্ছে তাকে। তবে তিনি বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু ও ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে চলেছেন। তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, কাশ্মীর কাশ্মীরিদেরই, এটা কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতাই কাশ্মীর সমস্যার একমাত্র সমাধান।
পশ্চিমবঙ্গের কিছু বামপন্থী হিন্দু নেতা ও কাশ্মীরিদের প্রতি ন্যায়বিচার করার জন্য দিল্লি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার ভয়াবহতার বিবেচনায় এসব প্রচেষ্টা খুবই সামান্য।
তৃতীয় বিশ্ব বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব কাশ্মীরিদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার নয়। এসব দেশের রাষ্ট্র নায়ক এবং রাজনীতিবিদরা পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবহ। পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক হোসাইন ওবামার নির্বাচনী ওয়াদাগুলোর মধ্যে কাশ্মীর সমস্যার ন্যায্য সমাধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু তিনিও তার কথা রাখলেন না। কদিন আগেই তিনি ভারত সফর করে গেছেন। অরুন্ধতী রায়ের ভাষায় ভারতের জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদীদের তিনি চটাতে চাননি, তাই কাশ্মীর প্রসঙ্গে তিনি মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলেন তার ভারত সফরের সময়। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র নায়করা তাদের মসনদ, সম্পদ এবং হেরেম রক্ষায় এত আন্তরিক যে, এসব স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কাশ্মীর বা ফিলিস্তিনের অধিকার দূরে থাকুক, কোনো মুসলিম রাষ্ট্র যদি নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য চেষ্টা সাধনা করে এবং তাতে যদি সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী শক্তি অসন্তুষ্ট হয়, তাহলে তারা সে মুসলিম রাষ্ট্রেরও ধ্বংস কামনা করতে পিছপা হন না। ইরাক আক্রমণের জন্য মিসরের হোসনি মোবারক আমেরিকাকে বার বার অনুরোধ করেন। লেবাননের রফিক হারিরি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমির ইরান আক্রমণের জন্য আমেরিকাকে প্ররোচিত করেছেন। পরাশক্তিগুলো কাশ্মীর নিয়ে স্বার্থ আদায়ের রাজনীতি করে চলছে, অথচ বিশ্বব্যাপী তারা প্রতিনিয়ত খবরদারি করে চলছে। জম্বু এবং আজাদী কাশ্মীর এই দুটির মাঝখানে অবস্থিত লাইন অব কন্ট্রোল। লাইন অব কন্ট্রোলের দুই পার্শ্বে কোটি কোটি মানুষ বসবাস করছে, এই কোটি প্রাণকে ক্ষুধা আর দারিদ্যের মধ্য রেখে দুই দেশের শাসক গোষ্ঠি একপক্ষ কাশ্মীরকে নিজেদের দখলে রেখে অন্য পক্ষ দখলের পাঁয়তায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে গত পাঁচ দশক ধরে। পাক- ভারতের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ এতই প্রবল যে , এরা পরস্পরকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য শ’ খানেক পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করে রেখেছে। এক একটি অস্ত্র তৈরিতে যে পরিমান অর্থ খরচ হয়েছে যা দ্বারা দুটি দেশের অসংখ্য দুর্দশাগ্রস্থ মানুষের দুর্দশা দূর করতে পারত। বর্তমান বিশ্বে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল ছাড়া আর কোন দেশ পাওয়া যাবেনা, যারা ভারত পাকিস্তানের মতো পরস্পরকে ঘৃনা করে। অথচ কাশ্মীর সমস্যা না থাকলে এই দুটি দেশ হতো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন, যারা যে কোন সমস্যায় এক অ্পরকে সাহায্য করত। তাই নির্দ্বিধায় উপমহাদেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বিশ্লেষকগণ কাশ্মীর সংকটকে দায়ী করছেন ।
পাক-ভারতের মধ্যকার এই কাশ্মীর সমস্যার সকল প্রতিফল পোহাতে হচ্ছে কাশ্মীরের জনগনের রিহীহ জনগনের। বর্তমানে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত বিভাজন (লাইন অব কন্ট্রোল) রেখা মেনে নিতে রাজি হলেও কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী জনগন আর পাকিস্তান রাজী নয় । পাকিস্তান রাজী না থাকলেও কোন ক্ষতি ছিল না যদিবা ভারত তাদের অধিকারী কাশ্মীরের গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে পারত। তবে যদি ভারতীয় কাশ্মীরের জনগনকে ভারত সরকার খুশি করতে পারত তাহলে কাশ্মীর সমস্যা কিছুটা হলেও সমাধানের সম্ভাবনা ছিল । কাশ্মীরকে যথেষ্ট স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করে গৃহযুদ্ধের অবসান অসম্ভব। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী অভ্যন্তরীন জটিলতার কারনে সেটা করতেও অক্ষম। তবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের যতগুলো পথ রয়েছে তারমধ্যে পর্যাপ্ত স্বায়ত্ত্বশাসনই ভারতীয় শাসকদের জন্য সহনীয়। ভারতীয় কাশ্মীর মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত, জম্মু,কাশ্মীর আর লাদাখ। জম্মু ও লাদাখ হিন্দু ও বেীদ্ধদের আবাসস্থল আর কাশ্মীর হল মুসলিমদের আবাস্থল। জম্মু আর লাদাখের জনগন ভারতে থাকার পক্ষপাতী অন্যদিকে কাশ্মীরের একপক্ষ চায় স্বাধীনতা অন্যপক্ষ চায় পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্তি। বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলারা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। এক ডজনের বেশী দল নিয়ে তারা গঠন করেছে হুরিয়াত কনফারেন্স। ভারত সরকার যদি মুসলিম প্রধান অঞ্চল কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তান সরকার এবং হুরিয়াতের সাথে সমঝোতায় আসতে পারে তবে সেক্ষেত্রে ছয় দশকের এই আন্তর্জাতিক সমস্যাটির দারুন মীমাংসা হতে পারে। এক্ষেত্রে উপায় হলো বেশ কিছু জায়গা পাকিস্তানের ছেড়ে দেয়া।
তবে কাশ্মীর সমস্যা অন্যভাবে সমাধান করা যেতে পারে। ভারত পাকিস্তানের অধিকৃত জায়গা সংযুক্ত করে যদি স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্র গড়ে তোলা যায় তবে তা হবে কাশ্মীরের জনগনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আন্তর্জাতিক শ্রেনীও বোধহয় এমন একটি সমাধান দেখতে সবচেয়ে বেশী আগ্রহী। সেক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তি রাষ্ট্র পাক-ভারতের মাঝে বাফার রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করবে এই ক্ষুদ্র স্বাধীন কাশ্মীর।
কাশ্মীর সমস্যা সমাধান যে একবারেই অসম্ভব তা নয়। ত্রুটি হলো দুটি দেশের রাজনৈতিক অপরিপক্কতা। বর্তমানে পাকিস্তান আবার ফিরে গেছে সেনা শাসনের পর পূর্বের অবস্থায় । যদিও ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয় , কিন্তু সে গণতন্ত্রও শুধু নির্বাচনের মাঝেই সীমাবদ্ধ, তার কার্যকারী কোন প্রতিফলন দেখা যায় না। দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাড়াতে পারেনি। কাশ্মীর ছাড়াও নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যায় জর্জরিত ভারতের পক্ষে তাই কাশ্মীরের ওপর বড় ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। কারণ হিসাবে দেখা যায় দেশটি তাহলে বিশ পঁিচশটি ভাগে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচন্ড। কিন্তু কাশ্মীর সমস্যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থেই বিশ্ববাসীকে প্রদান করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যর সমস্যা অর্থাৎ আরব- ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই আন্তর্জাতিক শক্তিধর সম্প্রদায় তাদের মনযোগ কাশ্মীরের ওপর পূর্ণমাত্রায় প্রদান করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা বর্তমানে কাশ্মীর বলতে শ’খানেক পারমানবিক বোমার বিস্ফোরনের সম্ভাবনা । তাই কাশ্মীরের অসহায় জনতার দিকে তাকিয়ে কাশ্মীরকে গণতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যার মাধ্যমে এই জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। নতুবা যতদিন এটি সম্ভব না হবে ততদিন এ সমস্যার অগ্রগতি এভাবেই চলতে থাকবে।

No comments

Powered by Blogger.