সিরিয়া সঙ্কট সমাধানে পাঁচ জাতি পরিকল্পনা by জিমি কার্টার

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে আমি চিনি যখন তিনি লন্ডনে কলেজের ছাত্র তখন থেকে। ক্ষমতায় আসার পরও তার সাথে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। মূলত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধেই তার কাছে গিয়েছি আমি। ওই সময় কূটনৈতিক বিরোধের জন্য দামেস্ক (সিরিয়ার রাজধানী) থেকে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
বাশার এবং তার বাবা হাফিজ আল আসাদ (সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ওই সময় একটি নীতি মেনে চলতেন, তারা আমেরিকান দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তার সাথে কথা বলতেন না। তবে আমার সাথে আলোচনা করতেন। আমি লক্ষ করেছি, বাশার কখনোই তার কোনো অধস্তনের কাছ থেকে পরামর্শ বা তথ্য চাইতেন না। চরিত্রগতভাবেই তিনি অত্যন্ত জেদি। মানসিকভাবে তার পক্ষে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনা প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে যখন তিনি চাপের মধ্যে থাকেন।
২০১১ সালের মার্চ মাসে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে নানা জাতিগোষ্ঠী আর ধর্মের মানুষের পাশাপাশি হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বাস করার একটি চমৎকার নজির তৈরি করেছিল সিরিয়া। দেশটিতে যেমন আরব, কুর্দি, গ্রিক, আরমেনীয় ও আসিরীয়রা বাস করেন তেমনি থাকেন খ্রিষ্টান, ইহুদি, শিয়া, সুন্নি ও আলাওয়াতিরা। ১৯৭০ সাল থেকেই আসাদ পরিবার দেশটির ক্ষমতায় রয়েছে। বিভিন্ন ধর্ম-গোত্রের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে একসময় তারা রীতিমতো গর্ব বোধ করতেন।
সিরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে যখন আন্দোলন শুরু হয়, গোড়ার দিকে প্রেসিডেন্ট বাশারের মনে হয়েছিল তার ‘বৈধ’ সরকারকে উৎখাত করতেই এই অবৈধ বিপ্লব। তিনি অপ্রয়োজনীয়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করে এই আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নানা জটিল সমীকরণের কারণে তিনি সেনাবাহিনী, খ্রিষ্টান, ইহুদি ও শিয়া মুসলমানদের সমর্থনও পেয়ে যান। এই গোষ্ঠীগুলোর মূল আশঙ্কা ছিল, বাশারকে সরালে কট্টরপন্থী সুন্নি মুসলমানেরা ক্ষমতা দখল করবে। ফলে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সম্ভাবনা সীমিত হয়ে পড়ে।
আশির দশকের গোড়া থেকেই কার্টার সেন্টার সিরিয়ার সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ওয়াশিংটনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথেও এ নিয়ে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান হয় আমাদের। কার্টার সেন্টার বরাবরই এই দ্রুত বাড়তে থাকা সঙ্ঘাতের (সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ) একটি রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে।
আর যুক্তরাষ্ট্র সমাধান চেয়েছে বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। কার্টার সেন্টারও তখন থেকেই এর বিরোধিতা করেছে। যদিও তা ছিল গোপনে। গত চার বছরে বাশারকে সরিয়ে দেয়ার মতো সে রকম কিছু ঘটেনি। বরং পুরো বিষয়টি আরো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এবং আলজেরিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাখদার ব্রাহিমিকে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে সিরিয়া সঙ্কট সমাধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাশার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং অন্য দেশগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হয়ে পরিত্যক্ত হয়।
এ বছরের মে মাসে ‘মুরব্বি’ হিসেবে পরিচিত বিশ্ব নেতৃবৃন্দের একটি দল মস্কো সফর করে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত, রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়েভগেনি প্রিমাকভ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারগেই ল্যাভরভ এবং নানা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সিরিয়া সঙ্কট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কারনেজিয়া সেন্টারের মস্কো শাখার বিশেষজ্ঞরাও উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় রাশিয়ার সাথে আসাদ সরকারের দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্কের বিষয়টি উঠে আসে। একই সাথে বলা হয়, রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ হলো সুন্নি মুসলমান। ফলে দেশটিতে ইসলামিক স্টেটের (সুন্নিপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠী) উত্থানের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের কাছে আমি তার প্রেসিডেন্ট বাশারকে সমর্থনের কারণ জানতে চাই। পাশাপাশি এ বছরই সিরিয়ার দুইটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিনিধির সাথে তার আলোচনার বিষয়েও জানতে চাই। তিনি জানান, অগ্রগতি খুব সামান্যই। তার মতে, এই সঙ্কটের সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে ইরান, তুরস্ক ও সৌদি আরবকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। এই দেশগুলো মিলে একটি সমন্বিত শান্তি পরিকল্পনা তৈরি করবে। তার বিশ্বাস, ইসলামিক স্টেট বাদ দিয়ে সিরিয়ার বাকি পক্ষগুলো এই পরিকল্পনা মেনে নেবে। প্রসঙ্গত ইরান ও রাশিয়া প্রেসিডেন্ট বাশারের সমর্থক। অন্য দিকে বাকি তিনটি দেশ বিরোধীদের সমর্থন করে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুমোদন পাওয়ার পর আমি বিষয়টি ওয়াশিংটনকে জানাই।
তিন বছর ধরে কার্টার সেন্টার সিরিয়ার রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত নানা গোষ্ঠী, সশস্ত্র বিরোধী গ্রুপগুলোর নেতৃবৃন্দ, জাতিসঙ্ঘের কূটনীতিক এবং ইউরোপের সাথে এই সঙ্কটের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা চালাচ্ছে কার্টার সেন্টার। এ গবেষণায় বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠীর অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এই গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিরিয়ার কোনো পক্ষই সামরিকভাবে এই সমস্যার ইতি টানতে সক্ষম নয়।
সম্প্রতি রাশিয়া বাশার সরকারের পক্ষে বিরোধী সশস্ত্র পক্ষগুলোর ওপর বিমান হামলা চালায়। অন্য সামরিক শক্তিগুলোও তাদের লড়াই জোরদার করেছে। ফলে সঙ্ঘাত বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে প্রতিবেশী দেশ এবং ইউরোপমুখী শরণার্থীদের ঢল। পরিস্থিতি দুইটি পথ স্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রথমত, সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য বাশার সরকারকে রাজনৈতিকভাবে আরো সুযোগ দিতে হবে। আর নয়তো ইসলামিক স্টেট আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে যা বিশ্বশান্তির পক্ষে হুমকিস্বরূপ। এসব বিকল্প মাথায় রেখেই পাঁচ দেশকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের মধ্যে মতপার্থক্যও বিস্তর।
[জিমি কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কার্টার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০০২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।]
অনুবাদ : তানজিলা কাওকাব

No comments

Powered by Blogger.