নেশাসক্ত ৫০ লাখ by আল-আমিন

পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক কলহ, বেকারত্ব, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে বাড়ছে মাদকের ব্যবহার। মাদকাসক্তরা অর্থের জোগান পেতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। একটি বেসরকারি সংস্থার ২০১৪-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ নেশাসক্ত মানুষ রয়েছে। যাদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের সংখ্যাই বেশি। মাদকসেবীদের একটি বড় অংশ নারী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নারীদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়েছে মাদক সেবনে। এমনকি গৃহবধূরাও মাদক নিচ্ছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকাসক্ত নারীদের মধ্যে শতকরা ৩ জন গৃহবধূ। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাত্র ১০ ভাগ মাদক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বাকি ৯০ ভাগ মাদক সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় মাদক ব্যবসা সিন্ডিকেটের সঙ্গে ৫০০ ব্যক্তির মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় ১৫০ জন। মাদক বহনে কেউ যেন সন্দেহ করতে পারে এজন্য শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে মাদক সেবনের কারণে ৫৭,০০০ হাজার লোকের মৃত্যু হয় এবং ৩,৮২,০০০ মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করে।
মাদক পাচার ও মাদকসেবীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিগত বছরগুলোতে ফেনসিডিল আসক্তের মাত্রা ১০ গুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে ফেনসিডিল আটকের সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। ফেনসিডিলের পর নেশা হিসেবে প্রচলন রয়েছে হেরোইনের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুধু ওই সংস্থাটি সারাদেশে ২৮,৫৫০ বোতল ফেনসিডিল, সাড়ে ৮ কেজি হিরোইন, ৮৭০০ বিদেশী মদ, ৪,৫৫০ কেজি গাঁজা, ৮,০০০ হাজার অ্যাম্পুল, ৬,৭৬০০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করেছে। দেশের সীমান্তবর্তী ৩২টি জেলায় প্রতিটি এলাকা দিয়ে মাদক প্রবেশ করে থাকে। তবে কক্সবাজার ও খাগড়াছড়ি মূলত ইয়াবা ব্যবসার মূল রুট। যোগাযোগ করা হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (নিরোধ, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকাশনা) নাজমুল আহসান মজুমদার জানান, মাদক শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের বড় সমস্যা। এ বস্তুটি একটি দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি আরও জানান, মাদক ব্যবসা উৎখাতের লক্ষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সারাদেশে ৪টি অঞ্চল, ২৫টি উপ-অঞ্চল, ২৫টি রেঞ্জ, ১০৯টি সার্কেল ও ৪টি গোয়েন্দা অঞ্চলের নিরন্তর অভিযান চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কারণে দেশে অনেকাংশে মাদক ব্যবহার করা যাচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এই মাদক বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সারাদেশে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মো. মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, মাদকের বিষয়ে পুলিশ জিরো টলারেন্স দেখায়।
অবাধে মাদক সেবন-বিক্রি: ঢাকার কয়েকটি এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে মাদকের অবাধ ব্যবহার। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন প্রভাবশালীরা। ঢাকার অভিজাত এলাকায় ইয়াবা, সিসা, ব্লু-আইশ, কোটামিন ও স্ট্রেইথি বেশি বিক্রি হয়ে থাকে।
গত শনিবার সকাল ১০টা। কাওরানবাজারের বড় মাছের আড়তের রেললাইনের পাশে বসা এক যুবতীর নাম জাবেদা বেগম। জাবেদা রেললাইনের বস্তির একটি খুপড়িঘরে বাবা মার সঙ্গে থাকে। তাকে দেখা গেল একটি বড় পলেথিনে হাতে করে ২০, ৩০ ও ৫০ টাকার পুড়িয়া করে গাঁজা বিক্রি করছে। গাঁজা বিক্রয়ের বিষয়টি প্রশাসন জানে কিনা প্রশ্ন করা হলে জাবেদা জানায়, সবাই জানে। সবাই আসে। সরেজমিন জানা গেছে, ওই রেললাইনের বস্তিতে কমপক্ষে ২০ জন পুরুষ ও নারী মাদকের ব্যবসা করে থাকে। এর মধ্যে কয়েকজন শিশুকেও ব্যবহার করা হয়।
শনিবার দুপুর ১২টায় রমনা থানাধীন মগবাজারের বৌবাজার বস্তি। পাশেই ওই থানার নয়াটোলা পুলিশ ফাঁড়ি। ওই বস্তির রিকশার গ্যারেজের পাশে শাহজাহান নামে এক মাদক ব্যবসায়ী তার দল-বল নিয়ে ইয়াবা ও গাঁজার ব্যবসা করে যাচ্ছে। বিষয়টি শাহজাহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, শুধু আমি নই, আরও কয়েকজন ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাদের জিজ্ঞাসা করেন।
কেস স্টাডি-১: রকিব (ছদ্মনাম)। জামালপুরের সদর থানার এক গ্রাম থেকে ঢাকা আসেন তিনি। মেধাবী এই তরুণ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। আগে তিনি সিগারেটও খেতেন না। কিন্তু এখন গাঁজা ও অ্যালকোহল জাতীয় নেশায় আসক্ত। রকিব জানান, প্রথম বর্ষে রিপা নামে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। প্রায় ১ বছর ধরে তার পেছনে ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু কোন সাড়া পাইনি। এরপর হতাশ হয়ে সিগারেট খাওয়া শুরু করি। এখন পুরোদমে গাঁজা সেবন করি। মাঝে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করলেও সেটি ব্যয়বহুল হওয়ায় এখন আর সেবন করি না। মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে এখন পড়ালেখা থেকে বহুদূরে রকিব।

No comments

Powered by Blogger.