স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ থাকছে না by শরিফুজ্জামান ও হারুন আল রশীদ

মন্ত্রিসভা অনুমোদন করলেও পৌরসভা আইনের খসড়া থেকে প্রশাসক নিয়োগের বিধান বাদ দিতে বলেছে আইন মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও তা সমর্থন করেছে। এর ফলে জেলা পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের সব স্তরে প্রশাসক নিয়োগের আর সুযোগ থাকছে না।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভবিষ্যতে আইনি জটিলতার আশঙ্কায় প্রশাসক নিয়োগের বিধান বাদ দিতে হচ্ছে। এ কারণেই অধ্যাদেশ জারি করতে দেরি হচ্ছে। ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় বিষয়টি অনুমোদন করার কয়েক দিনের মধ্যে অধ্যাদেশ জারির কথা ছিল। ইতিমধ্যে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে অধ্যাদেশ জারি হতে পারে বলে মন্ত্রণালয় আশা করছে। তবে নির্বাচন কমিশন মনে করে, অধ্যাদেশ জারির সময় পেছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর চাপ বাড়ছে।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে পরিচালিত হবে এবং একজন জনপ্রতিনিধি আরেকজন জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। পৌরসভার মেয়রদের সংগঠনও এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছিল। তারা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়টি তুলে ধরে। শেষমেশ সংগঠনের একাধিক নেতা প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি হলে মামলার ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি সংবিধান ও আইনের সঙ্গে যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি বাদ দেওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার পরিচালিত হওয়ার কথা। সে জন্য সরকারের লক্ষ্য তৃণমূলে গণতন্ত্র শক্তিশালী করা। আর প্রশাসক নিয়োগ করলে তা সম্ভব হবে না।
১২ অক্টোবর ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে করার প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। হাতে সময় কম থাকায় পৌরসভা আইনটি অধ্যাদেশ আকারে জারির সিদ্ধান্ত হয়। ওই অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন না হলে পরিষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, প্রশাসক নিয়োগের বিধান বাদ দিয়ে অধ্যাদেশ বা আইন করা হলে বলতে হবে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। এখন সরকারের উচিত হবে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের যে বিধান আছে, সেটিও বাতিল করা এবং নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে জেলা পরিষদ ছেড়ে দেওয়া।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে মন্ত্রিসভায় স্থানীয় সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সংশোধন আইন অনুমোদন হওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষ করে দল-মতনির্বিশেষে জনপ্রতিনিধিরা প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠছিল যে, বিষয়টি মামলা-মোকদ্দমার দিকে গড়াচ্ছিল। তিনি আরও বলেন, ২০০৫ সালে উচ্চ আদালতের এক রুলে বলা হয়েছিল, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আরেকজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি তাহলে অবৈধ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সিটি করপোরেশন বিভক্ত হওয়ার ফলে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কারণ, নতুন দুটি সিটি করপোরেশন সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে প্রথমে প্রশাসক দিয়েই কাজ শুরু করতে হয়েছে। স্থানীয় সরকারের যেকোনো নতুন প্রতিষ্ঠান প্রশাসক দিয়ে শুরু করতে হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ম্যাব) সাধারণ সম্পাদক ও সিংড়া পৌরসভার মেয়র শামীম আল রাজি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধ্যাদেশ বা আইনে প্রশাসক নিয়োগের বিধান থাকলে আমরা মামলা করব। কারণ, এই বিধান হাইকোর্টের নির্দেশনা ও সংবিধানের পরিপন্থী।’ তিনি আরও বলেন, ম্যাব নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। পিছিয়ে দেওয়া হলে এবারের হালনাগাদে যাঁরা নতুন ভোটার হচ্ছেন, তাঁরা ভোট দিতে পারবেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, আগামী জানুয়ারির মধ্যে ২৪৫টি পৌরসভায় নির্বাচন করতে হবে। তবে কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন শেষ করতে চায়। কারণ, ১ জানুয়ারি হালনাগাদ করা ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশিত হবে এবং ৩১ জানুয়ারি চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
কমিশন সচিবালয়ের সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, আইনগতভাবে জানুয়ারিতে নির্বাচন করতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু খসড়া তালিকা প্রকাশের পর নতুনদের ভোট দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে নির্বাচন করাটা নৈতিকভাবে সমর্থন করা কঠিন। সে জন্যই কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে চায়।
এদিকে মন্ত্রিসভায় দলীয় মনোনয়নে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি অনুমোদন হওয়ার পর মাঠপর্যায়ে নির্বাচনী হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে সরকার-সমর্থক প্রার্থীরা আইন বা অধ্যাদেশ হওয়ার আগেই মাঠে নেমে পড়েছেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ে অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছে। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে। তারপরও এই নির্বাচনের মাধ্যমে তৃণমূলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.