উন্মাদ উবাচ by সৈয়দ আব্দুল হাদী

পাঠক, বিস্মৃত হয়েছেন কি খলিলুল্লার কথা, যিনি নর-কলিজা ভক্ষণ করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়েছিলেন? সারা দেশের কৌতূহলী মানুষের বৈঠকখানা থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে চায়ের দোকানের আড্ডায় আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন? তাঁকে তখন উন্মাদ বা মানসিক ভারসাম্যহীন বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং কিছুদিনের মধ্যে যথারীতি আমরা বিষয়টি বিস্মৃতও হয়েছিলাম।
খলিলুল্লা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়তো কিছুটা ছিলেন, সম্ভবত তার চেয়েও বড় কারণ তিনি নিদারুণ অপুষ্টিতে ভুগছিলেন, দেখা দিয়েছিল রক্তশূন্যতা। চিকিৎসক তাঁকে খাসি-গরুর কলিজা খেতে বলেছিলেন, কিন্তু হতদরিদ্র খলিলুল্লার পক্ষে দুর্মূল্য গরু-খাসির কলিজা জোগাড় করা ছিল সাধ্যাতীত। তাই তিনি সহজলভ্য নর-কলিজাকেই প্রায় নিখরচায় জোগাড়ে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ঘটনাটি আমাদের মধ্যে যতটা কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল, ততটা ব্যথিত হয়েছিলাম কি আমরা? হোক না সে মানসিক ভারসাম্যহীন; কেন তাঁকে এ পথ বেছে নিতে হয়েছিল? ক্ষুধা, জীবনের প্রতি অনীহা নাকি সমগ্র মানবসমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন তিনি?
এমনই কত ভক্ষক আর ভক্ষিতের উপাখ্যান আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্ষণিক উত্তেজনার ঢেউ তুলে যথারীতি মিলিয়ে যাচ্ছে, আমরা কি তা মনে রেখেছি? না। আমরা বড় ভুলোমনা। আমাদের স্মৃতিশক্তি ‘পদ্ম পত্রে নীর’।
পাঠক, মনে পড়ে কি সেই হতভাগ্য মানবসন্তানের কথা, যাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ১৮টি টুকরা ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ছড়ানো-ছিটানো ছিল? হিন্দি সিনেমার সেই বিখ্যাত গান: ‘এক দিলকে টুকরে হাজার হুয়ে কোয়ি ইয়াহা গিরা, কোয়ি উয়াহা গিরা...’। এই গানের গীতিকার কল্পনার রং মিশিয়ে এ রসিকতাটুকু করেছিলেন। তিনি আজ জীবিত থাকলে দেখতে পেতেন তাঁর কল্পনার দৌড়কেও বাস্তবে হার মানিয়েছি আমরা।
টক শোতে, খবরের কাগজে অহরহ আলোচিত হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচারহীনতার কথা, যার সবই কমবেশি সত্য। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের এত গবেষণায় পোষাবে না, আমরা বরং সেই উন্মাদ খলিলুল্লার শরণাপন্ন হই। কেননা, উন্মাদের কথার কোনো সংগতি বা খেই না থাকলেও রাখঢাক কিংবা ছলচাতুরী নেই। সত্যি কথা ফস করে বলে ফেলে। কোনো মুনাফেকিও নেই।
খলিলুল্লা এখন স্বর্গে আছেন না নরকে আছেন জানা নেই, তবে যেখানেই আছেন, আমাদের অবস্থা দেখে হয়তো মুচকি হাসছেন আর ভাবছেন, ‘আমি তো মৃত মানুষের কলিজা ভক্ষণ করেছিলাম, যা পচে মাটিতে মিশে যেত, কিন্তু তোমরা যে জীবিত মানুষের কলিজা ছিঁড়ে খাচ্ছ, তার কী হবে! শুধু কি তাই, হলিউড, বলিউড সিনেমার মতো কত বীভৎসভাবে নিজ প্রজাতিকে তিলে তিলে নিধন করা যায়, সেই দৃশ্য দেখে উল্লসিত হচ্ছ। নারী-শিশু নির্যাতনের বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করছ। ধিক, তোমাদের বিকৃত মানসিকতাকে! ধিক, যারা শিল্পের নামে এই বিকৃত মানসিকতাকে পুঁজি করে, স্থূল আদিরসাত্মক বিনোদন-বাণিজ্যের বেসাতি করে, সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ত্বরান্বিত করছে! ভাইয়েরা আমার, এদের পেছনে গাঁটের পয়সা খরচ করে নৃশংসতার পাঠ নিয়ো না। দয়া করে ক্ষান্ত হও তোমরা।
‘আমার বড় কষ্ট হয় কারণ, আমিও ছিলাম তোমাদের মতোই এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একজন। তোমরা বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করো, নিজ প্রজাতির প্রাণ সংহার কোরো না। আর ইহজগতের প্রভুদের বলো—দয়া করে আর “খাই খাই” করবেন না। আপনাদের “খাই খাই” চরিতার্থ করতে আমাদের ব্যবহার করবেন না। অবশ্য তাঁরা বলতে পারেন, এই বেকারের দেশে তোমাদের তো তাও একটা কাজ দিচ্ছি। বেশুমার কর্মীর হাতকে কর্ম না দিলে তো অপকর্ম করবে। দেখো না, কর্ম না পেয়ে কেমন অপকর্ম করছ তোমরা—সমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে বিদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে নিজেদের প্রাণ তো দিচ্ছই, দেশেরও বদনাম করছ।
‘তার চেয়ে ঘরে বসে টু পাইস রোজগার করবে, এটা কি অনেক ভালো নয়? হ্যাঁ, অতি বাস্তব কথা। তবে তাদের বলো, দয়া করে কর্ম দিতে গিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য সৃষ্টি করবেন না।’
কিন্তু কেন এ অবস্থায় উপনীত হলাম আমরা? কেন এ অপমৃত্যুর মিছিল? কেন এ নৃশংসতার উৎসব? আমাদের জীবনের
কি কোনো মূল্য নেই? কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছি!
সৈয়দ আব্দুল হাদী: গায়ক।

No comments

Powered by Blogger.