ইনক্রিমেন্ট দিয়ে ক্ষতি পোষাতে চায় সরকার by ফখরুল ইসলাম

নতুন জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর প্রশাসনের সঙ্গে ২৬ ক্যাডারের দূরত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ক্ষোভ থামছে না। প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি থেমে থেমে কর্মসূচি পালন করছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা শনিবার নতুন কর্মসূচি দেওয়ার আভাস দিয়ে রেখেছেন।
এই পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এখন সতর্কতার সঙ্গে গোটা বিষয়টি দেখভাল করছেন। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অর্থমন্ত্রীর চাওয়া হচ্ছে, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট এমনভাবে করতে হবে, যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মনে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের ক্ষোভ আর না থাকে। এ ছাড়া ১০ বছর একই পদে থাকার পর সরকারি কর্মচারীরা যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতর ধাপে যেতে পারেন, তা-ও চান অর্থমন্ত্রী।
তবে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাতিলের ক্ষতি পোষাতে চাইলেও বাস্তবে তা সম্ভব নয় বলে মনে করছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন। এরই মধ্যে প্রশাসন ক্যাডার বেশি সুবিধা পাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে অন্যান্য ক্যাডারের পক্ষ থেকে।
সরকারি চাকরিজীবীদের বিদ্যমান সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের জন্য ফরাসউদ্দিন কমিশন প্রথম সুপারিশ করে। যদিও কমিশনের প্রতিবেদনে এই বাতিলের সঙ্গে বেতনকাঠামোর ধাপ ২০ থেকে ১৬-তে নামিয়ে আনার সুপারিশ ছিল। একটি বাস্তবায়ন করে আরেকটি না করায় অসংগতি তৈরি হয়েছে বলে কমিশন মনে করে।
এরই মধ্যে আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কেবল প্রশাসন ক্যাডারের ৩০৬ জন কর্মকর্তাকে সিলেকশন গ্রেড দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এ নিয়েও দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সদ্যবিদায়ী সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার নেতৃত্বাধীন পর্যালোচনা কমিটি এবং পরে মন্ত্রিসভা কমিটিও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের পক্ষে মত দেয়। তবে সরকারি চাকরিজীবীরা তা মানতে চাইছেন না। আর এই সুবিধা বাদ পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, বেতন বাড়লেও তাঁদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি তৃতীয় গ্রেডে আটকে থাকছে।
সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল হলে বেতন-ভাতায় তুলনামূলক ঠকবেন—এ কথা জানিয়ে কর্মচারীরা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। অর্থমন্ত্রীও দাবি বিবেচনার আশ্বাস দেন তাঁদের। যুক্তরাষ্ট্র ও পেরু থেকে ২৫ দিন পর ১৭ অক্টোবর দেশে ফেরেন অর্থমন্ত্রী। এর আগেই বিষয়টির ওপর নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ দেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাস্তবায়ন অনুবিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ অক্টোবর অর্থ বিভাগ বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। ২৬ অক্টোবর কর্মচারীদের পক্ষ থেকে বিষয়টি অর্থমন্ত্রীকে জানানো হলে তিনি ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত আনার নির্দেশ দেন।
এদিকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের সঙ্গে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টকে মিলিয়ে দেখার বিপক্ষে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। বেতনবৈষম্য দূরীকরণ-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীকে এক লিখিত আবেদনে সংগঠনটি জানায়, ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের অজুহাতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব অযৌক্তিক। উল্লেখ, প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে নতুন বেতনকাঠামোতে।
অর্থমন্ত্রীকে কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল হলে প্রতিটি ধাপে সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, অঙ্ক কষে তার একটি হিসাব দিয়েছেন। হিসাবের মধ্যে ২০তম ধাপকে উদাহরণ হিসেবে বেছে নিলে দেখা যায়, প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী, পদোন্নতি ছাড়াই ২০৩০ সালে ২০তম ধাপের মূল বেতন হবে ১৭ হাজার ১৫১ টাকা। আর টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল থাকলে ২০৩০ সালে ২০তম ধাপের মূল বেতন হবে ১৮ হাজার ৭১০ টাকা।
কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের মহাসচিব মো. রুহুল আমিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাকরিতে পদোন্নতি সাংবিধানিক অধিকার। বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধিও তাই। এর সঙ্গে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা অঙ্ক কষে এবং যুক্তি দিয়ে আমাদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরলেও কেউই তা বুঝতে চাইছেন না।’
ইনক্রিমেন্ট দিয়ে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের ক্ষতি পোষানোর উদ্যোগ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী—এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল আমিন বলেন, ‘এটাও যে ভুল উদ্যোগ, অর্থ মন্ত্রণালয়কে তা-ও আমরা জানিয়েছি।’
সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত যখন প্রায় চূড়ান্ত, কর্মচারীরা যখন তা বহালের দাবিতে আন্দোলন করছেন—গত ৩ আগস্ট তখন ঘটে নতুন ঘটনা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওই দিন শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ৩০৬ জন কর্মকর্তাকে সিলেকশন গ্রেড দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত ২ জুলাই থেকে তা কার্যকর করা হয়। একই ব্যাচের অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অবশ্য একই সুবিধা দেওয়া হয়নি।
এই সময়ে এসে কেন এমন বৈষম্যমূলক কাজ করা হলো—জানতে চাইলে অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার জন্য একই সুবিধাই তো হওয়ার কথা।’ বিষয়টি তিনি খোঁজ নেবেন বলে জানান।
শুধু একটি ব্যাচের ও একটি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সিলেকশন গ্রেড দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে, তাই আগের বেতনকাঠামোর ধারাবাহিকতায় নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণার আগে তাঁদের সিলেকশন গ্রেড আমরা দিয়েছি। দেওয়ার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামতও নিয়েছি।’ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সিলেকশন গ্রেড দেওয়ার ক্ষমতা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নেই বলেও জানান তিনি।
নভেম্বর মাসে নতুন বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থসচিব প্রথম আলোকে বলেন, কাজ শেষ হয়নি। কবে প্রজ্ঞাপন হবে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে তিনি বলেন, যখনই প্রজ্ঞাপন জারি হোক, তা কার্যকর হবে গত ১ জুলাই থেকেই।

No comments

Powered by Blogger.