ডাকাতি, অপহরণ আর মুক্তিপণে সর্বস্বান্ত জেলেরা by নেছারউদ্দিন আহমেদ টিপু

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে গত তিন মাসে শতাধিক মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতেরা ট্রলারগুলো থেকে জাল, জ্বালানি ও মাছ লুটের পাশাপাশি জেলেদেরও অপহরণ করে। আর অপহৃতদের উদ্ধারে মুক্তিপণ দিতেই সর্বস্বান্ত হচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
আলীপুর ও মহিপুর মৎস্য বন্দরের মৎস্য ব্যবসায়ীদের এক হিসাব মতে, গত তিন মাসে কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগরে অন্তত ১১০টি ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতেরা পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও পাথরঘাটা এবং বরগুনার এ উপকূলীয় এলাকার অন্তত ১০০ জেলেসহ ২০টি ট্রলার অপহরণ করেছে। এ ছাড়াও জাল, জ্বালানি তেল ও মাছসহ কোটি টাকার জিনিসপত্র লুট করেছে। মুক্তিপণ দিয়ে অপহৃত জেলেদের কেউ কেউ ফিরলেও এখন পর্যন্ত জিম্মি রয়েছেন অন্তত ২৫ জন।
আলীপুর মৎস্য বন্দরের আড়তদার ও জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি অক্টোবর মাসে তিন দফায় অন্তত ৫৫টি ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) গভীর রাতে মাছ ধরে ফেরার সময় ‘এফবি এলমা আক্তার’ নামে এ মৎস্য বন্দরের আবুল কোম্পানির ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। এতে জাল, জ্বালানি তেল ও মাছসহ অন্তত ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট হয়েছে বলে দাবি করেছেন ট্রলারটির মালিক। ডাকাতেরা ওই ট্রলারে করেই রুহুল আমীন মাঝি (৪০), মো. শুক্কুর আলী (৪২) এবং মো. শানু মিয়া (৫০) নামে তিন জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া মো. আল আমীন (২৫), মো. নাঈম (২২) ও মো. বজলুর রহমান (৪৫) নামে অন্য দিন জেলেকে সাগরে নিক্ষেপ করেছে। এখন পর্যন্ত ট্রলার ও ওই জেলেদের হদিস পাওয়া যায়নি।
এর আগে ১৩ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে জেলেদের ট্রলারে ডাকাতেরা গুলি করে। এতে ফয়সাল (৩০), আহসান আলী (৩২), শাহ আলম (৪০) ও কাইয়ুম (২৯), আবদুল মান্নান মৃধা (৩০) ও আমির হোসেন (৩৩) নামে পাঁচ জেলে আহত হন। ওই দিন ডাকাতেরা আলীপুর মৎস্য বন্দরের মো. আনসার উদ্দিন মোল্লার ‘এফ বি মার্জিয়া’ ট্রলারে করে নয়া মিয়া, আল-আমিন ও আবুল কালাম নামে তিন জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
‘এফ বি মার্জিয়া’ ট্রলারের মালিক জানান, দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে নয়া মিয়া ফেরত এসেছেন। কিন্তু মুক্তিপণ না দেওয়ায় মুক্তি মেলেনি আল-আমিন ও আবুল কালামের।
তার​​ ও আগে ২৪ আগস্ট দুপুরে বঙ্গোপসাগরে অন্তত ৫০টি ট্রলারে গণডাকাতি হয়েছে। ওই সময় ডাকাতেরা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ‘এফবি তিমন’ ট্রলারের মাঝি লালচান (৩২) ও ‘এফবি মায়ের আশীর্বাদ’ ট্রলারের মাঝি মো. বশির হোসেনকে (৩৫) অপহরণ করে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত ওই দুই জেলে মুক্তি পাননি।
আলীপুর মৎস্য বন্দরের আড়তদার আবুল হোসেন কাজীর ভাষ্য, ‘সাগরে ডাকাতি করার সময় ডাকাতেরা নিজেদের দয়াল, মজনু, মাস্টার, আলীফ, বাচ্চু ও এনামুল বাহিনী নামে পরিচয় দেয়। এগুলো মূলত ছদ্ম নাম। এ ডাকাত চক্রের পেছনে খুলনা ও বাগেরহাটের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। এর মধ্যে খুলনার ফুলতলার দামোদর এলাকার বাচ্চু বেগ (গালা বাচ্চু) ওরফে ব্লাক বাচ্চুর নাম সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। তিনি ভারতে অবস্থান করে তাঁর সহযোগী খুলনার ডুমুরিয়ার এনামুলের মাধ্যমে ট্রলারগুলোতে ডাকাতি করান। এ কাজে ডাকাতেরা উচ্চ কার্যক্ষমতা সম্পন্ন ইঞ্জিন ব্যবহার করে।’
মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসা জেলেদের বরাত দিয়ে কুয়াকাটা-আলীপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘আমরা শুনেছি ৩০ জেলের মুক্তিপণ বাবদ যে অর্থ পাওয়া যায়, তা খুলনা এলাকার প্রশাসন, নেতা ও সাংবাদিকদের জন্য ব্যয় হয়। এ জন্য ওদের ৫০ জনের মতো জেলেকে জিম্মি করতে হয়। বাকি ২০ জেলের মুক্তিপণের অর্থ জলদস্যু এবং তাদের নিয়ন্ত্রণকারীরা ভাগাভাগি করে নেয়।’
মহিপুর মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. ফজলু গাজি বলেন, ‘এ বছর দফায় দফায় ডাকাতির কবলে পড়ে জেলেরা ছাড়াও আমরা মৎস্য ব্যবসায়ীরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছি। প্রতি বছরই ডাকাতদের মুক্তিপণ দিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মৎস্যজীবীরা কিচ্ছু চাই না, সাগরে নিরাপদে মাছ ধরার নিশ্চয়তা চাই।’
একই সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, ‘সাগরে জল দস্যুতা রোধ হচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে জেলেরা বেকার সময় কাটায়। আর আবহাওয়া ভালো হলে সাগরে মাছ ধরতে গেলে ডাকাতেরা অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর মুক্তিপণ দাবি করে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে জেলেরা যেমন এ পেশা ছেড়ে দেবে, তেমনি আমরাও ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হব।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আজিজুর রহমান বলেন, ‘সাগরে ডাকাতিগুলো সাধারণত খুলনা-বাগেরহাটের জলসীমানায় হয়ে থাকে। ডাকাতির শিকার হওয়া কলাপাড়া উপজেলার জেলেরা এসে জানালে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনি পদক্ষেপ নিই। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশ-কোস্টগার্ডকে অবহিত করি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্ট গার্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের স্টাফ অফিসার (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলেরা সত্যিকারভাবে চিহ্নিত করে বলতে পারছে না কোন জায়গায় নিয়ে জেলেদের আটকে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে, যেসব জেলে মুক্তিপণ দিয়ে বের হয়ে আসে, তাঁরাও এসে আর মুখ খুলছেন না। তাঁরা যদি আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতেন, তাহলে আমরা সেভাবে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’
ফজলুল করিম আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কারা জেলে, কারা ডাকাত তা চিহ্নিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেলেদের আইডি কার্ড দেওয়া হতো, তাহলে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হতো। আমরা মনে করি, সে ক্ষেত্রে সাগরবক্ষে ডাকাতিও বহুলাংশে কমে যেত। তা ছাড়া সুন্দরবন বিশাল জায়গা, সেখানে কাজ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগের জনবল বৃদ্ধি করলে, তাঁদের অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করা হলে জল দস্যুতা রোধে অন্য বাহিনীর সঙ্গে তাঁরাও ভূমিকা রাখতে পারতেন।’

No comments

Powered by Blogger.