যন্ত্রের নাম 'ষড়যন্ত্র'! by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

আমেরিকা, ইউরোপ আর এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ধনী ও উন্নত দেশগুলো যখন প্রযুক্তিগত উন্নতির শিখরে পৌঁছার জন্য নানা রকমের যন্ত্র আবিষ্কার করে চলেছে, তাতে প্রভাবিত হয়েই হয়তো আমাদের বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারও সাম্প্রতিক সময়ে এক যন্ত্রের পেছনে তাদের পুরো সরকারি মনোযোগ নিবিষ্ট করেছে। যন্ত্রটির নাম 'ষড়যন্ত্র'।
বাংলাদেশের বাজারে যন্ত্রটি যে একেবারে নতুন আমদানি হয়েছে, এমনটি নয়। অখণ্ড বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌলাকে উৎখাতেও যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু যন্ত্রটি যেহেতু হাতে ছোঁয়া যায় না বা চোখে দেখা যায় না, তাই এর কদর বেশ কমে গিয়েছিল বাংলাদেশে! বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও আর উৎসাহী ছিল না যন্ত্রটির ব্যাপারে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এ যন্ত্রের কথা যখন প্রায় ভুলতেই বসেছিল, ঠিক তখন এ যন্ত্রটিকে এবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। নানা জনসভা ও পত্রিকায় বিবৃতিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা তিন মাস ধরে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ঘটনা, সংসদ সদস্যদের নিয়ে টিআইবি রিপোর্ট সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সরকার উৎখাতের জন্য এবং কখনো কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য এ যন্ত্রটিকে দায়ী করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রায় সব বড় ধরনের ঘটনা ও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে 'ষড়যন্ত্র' ব্যবহারের অভিযোগ করে আসছিলেন।
আর এবার গত সপ্তাহে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১১ জন মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায়ও এ যন্ত্রের হাত রয়েছে বলে স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনার পর পর সারা দেশের মানুষ যখন গভীর বেদনায়, এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়েছিল সরকার এ ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার জন্য, তখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে এ ঘটনার জন্যও ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করলেন। সংসদে তিনি বললেন, 'এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথমে পুলিশ, তারপর গার্মেন্ট। এরপর কিসের ওপর হামলা হবে, সেটা দেখতে হবে।'
কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য 'ষড়যন্ত্র' নামক যন্ত্রটির অবদান যে একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু আমাদের সরকারি দল আওয়ামী লীগ যেভাবে সব ঘটনায় গড়পড়তা ষড়যন্ত্রকে দায়ী করছেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যে সুশীল সমাজে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে এ জন্য যে পৃথিবীর যেকোনো দেশে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, কেউ যেন কারো ওপর হামলা করতে না পারে বা কেউ কারো সম্পদ আগুনে পুড়িয়ে বা অন্য যেকোনো উপায়ে হোক বিনষ্ট করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। আর কোনো কারণে যদি ঘটনা ঘটেও যায়, সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করাও রাষ্ট্রের কাজ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রের কথা বললেও পত্রিকাগুলোতে লেখা হয়েছে প্রাণহানির পেছনে তাজরীন ফ্যাশনসের সরু সিঁড়ির কথা, আগুন নেভানোর উপকরণগুলোর কাজ না করার কথা, বেরিয়ে যাওয়ার দিকচিহ্নসংবলিত এঙ্টি মার্কিং না থাকার কথা। আবার কোনো কোনো পত্রিকায় লেখা হয়েছে, আগুন লাগার পর শ্রমিকরা কারখানার ওপরের তলা থেকে নিচে নেমে যেতে চাইলে প্রোডাকশন ম্যানেজার শ্রমিকদের বাধা দিয়ে বলেন, নিচে আগুনের মহড়া হচ্ছে, ভয়ের কিছু নেই। তারপর গেট বন্ধ করে উচ্চ স্বরে গান বাজানো শুরু হয়। আর এর ফলে ঘটে বিপুল প্রাণহানি। অথচ প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে একটি কথাও বললেন না ।
ঘটনার ব্যাপারে যথাযথ তদন্তের আগে প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রকে যতই দায়ী করুন না কেন, বাংলাদেশে গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর ভেতর ২০০০ সালে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৬৫ জন, ২০০৪ সালে ২৬ জন, ২০০৫ সালে ৭৮ জন, ২০০৬ সালে ৯১ জন, ২০১১ সালে ২১ জন এবং তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনা বাদ দিয়ে ২০১২ সালে হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্টে আগুন লেগে মারা গেছেন ২৬ জন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফ্যাক্টরি মালিক আর সরকার এসব পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিয়েছে। আর তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী বরং ষড়যন্ত্রের ওপরই দায় চাপিয়ে পার পেয়ে যেতে চেয়েছেন।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায়, সংসদ সদস্যদের নিয়ে টিআইবি রিপোর্ট ও তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনা- প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকারি দল কর্তৃক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করার পরিপ্রেক্ষিতে দুর্মুখেরা বলছেন, যতই যুক্তি উপস্থাপন করা হোক না কেন বা যত কলামই লেখা হোক, আমাদের মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা সত্যিকারের তদন্ত বা কারণ অনুসন্ধান না করে সব ঘটনার পেছনে নাশকতা, সরকার উৎখাত অথবা জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের 'ষড়যন্ত্র' ছাড়া আর কিছুই ধর্তব্যের ভেতর নিচ্ছেন না। তাঁদের মত হচ্ছে, যে ঘুমায় তাকে জাগানো যায়; কিন্তু আমাদের সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা তো জেগে ঘুমান, তাদের জাগাবে কে?
লেখক : গল্পকার, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
shahnewazbiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.