আবারও আবুল হোসেন- আটকে যেতে পারে পদ্মা সেতু

সৈয়দ আবুল হোসেনের কারণে আবারও আটকে যাচ্ছে পদ্মা সেতু। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর নামটি বাদ দিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে চাইছে। তবে তাতে সম্মত হয়নি বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল। তারা বলেছে, মূল নাম বাদ দিলে তা বিশ্বব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
সরকারের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র জানায়, দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্ত শেষে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ১০ জনকে দায়ী করে ৮৬ পৃষ্ঠার একটি খসড়া প্রতিবেদন জমা দেন। কিন্তু কমিশন সেখান থেকে দুজনের নাম বাদ দিয়েছে। বাদ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। অথচ বিশ্বব্যাংকের মূল অভিযোগই তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বাদ দেওয়া হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর নাম।
জানা গেছে, মূল তদন্ত প্রতিবেদনে ১০ জনকে দায়ী করা হয়েছে। তাঁরা হলেন: সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী, সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্যসচিব কাজী ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় এজেন্ট মো. মোস্তফা এবং এর তিন কর্মকর্তা সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল।
এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য পরামর্শক সংস্থা নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, মন্ত্রী-সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির উদ্যোগ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে এঁদের সবার বিরুদ্ধেই মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, কমিশনার এম বদিউজ্জামান, এম সাহাবুদ্দিন, বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত সেলের মহাপরিচালক খন্দকার আমিনুর রহমান এবং দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই করেন। এ সময়ই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
এরপর বেলা তিনটা পাঁচ মিনিটে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দল দুদকে আসে। হরতালের কারণে আগের দিন বৈঠকটি বাতিল করা হলেও গতকাল দুপুরে সিদ্ধান্ত বদল করে তারা দুদকে আসে। দলে ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান আইনজীবী লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো, হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং এবং যুক্তরাজ্যের সিরিয়াস ফ্রড কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের প্রধান অ্যালেন গোল্ডস্টেইনও সঙ্গে ছিলেন।
বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যদের জানানো হয়, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিপক্ষে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে জোরালো কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। ফলে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে এখনই মামলার সরাসরি সুপারিশ করা যাচ্ছে না। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে আরও অনুসন্ধান চালানো হবে। এ প্রসঙ্গে কানাডা পুলিশের প্রতিবেদন বা কানাডার আদালতে জমা করা রমেশ সাহার ডায়েরির অনুলিপি (সার্টিফায়েড কপি) বিশ্বব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়।
টানা সোয়া ঘণ্টা বৈঠকটি চলে। এ সময় দুদকের বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয়নি বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ দলটি। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশের আইনের আওতায় আনতে চায় দুদক, অথচ দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মূল ব্যক্তিটিকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
বৈঠক শেষে বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কাছে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেন, ‘আমরা এখনো দুদকের সঙ্গে আলোচনা করছি। কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে। এসব নিয়ে আগামীকালও (আজ বুধবার) আমাদের বৈঠক রয়েছে।’
দুদকের আইন উপদেষ্টা আনিসুল হক এরপর সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনুসন্ধানের খসড়া প্রতিবেদন মূল্যায়ন এখনো শেষ হয়নি। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় আমরা একমত হয়েছি যে আগামীকাল বেলা তিনটায় আমরা আবারও আলোচনায় বসব। তারপর একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেব।’ তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, ষড়যন্ত্রের মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান দলের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে মামলায় কতজন থাকবেন বা কার কার নাম এসেছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘আসামিদের সংখ্যা ১০ থেকে কম হবে।’ তবে কারও নাম প্রকাশ কিংবা মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর নাম রয়েছে কি না, তা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। গোলাম রহমান এ সময় আরও জানান, আজ বুধবার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় কিছু নাম সংযোজন বা বিয়োজন হতে পারে।
প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম বাদ: সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম দুদকের কাছে জবানবন্দিতে বলেছেন, এসএনসি-লাভালিনকে কাজ দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী ও সেতুসচিবসহ অন্যরা তৎপর ছিলেন। তিনি এও বলেছেন, এসএনসি-লাভালিন ছিল একটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠান। হালক্রো নামক প্রতিষ্ঠানটি যোগ্য বিবেচিত হলেও প্রভাবশালী মহলটি ভুল বুঝিয়ে লাভালিনের পক্ষে কার্যাদেশ আদায় করে নিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে রফিকুল ইসলামকে আসামির পরিবর্তে সাক্ষী করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবেরের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশে বলা হয়, তিনিও লাভালিনের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করেছেন।
সূত্র জানায়, এসএনসি-লাভালিনের তিন কর্মকর্তাকে মামলার আসামি হিসেবে সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনজনই বাংলাদেশে এসে মন্ত্রী-সচিবসহ সরকারি-বেসরকারি প্রভাবশালীদের সঙ্গে একান্তে দেখা করে তাঁদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফলে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওই তিন বিদেশি কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগটি প্রমাণিত।
আরও ১৫ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান: এদিকে, দুদক ১৫ জনের বিরুদ্ধে আরও অনুসন্ধানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১৫ জনের এই তালিকায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, ছুটিতে থাকা প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও রয়েছেন বলে জানা গেছে। এই তালিকায় আরও আছেন সাবেক প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সওজের প্রধান প্রকৌশলী তরুণ তপন দেওয়ান, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মকবুল হোসেন এবং বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ।

No comments

Powered by Blogger.