আবুলসহ ৮ জনের নামে মামলার সুপারিশ by হায়দার আলী

শেষরক্ষা হচ্ছে না মহাজোট সরকারের সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর। পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে- এমন অভিযোগে এ দুজনসহ দুদকের মামলায় আসামি হতে যাচ্ছেন আট প্রভাবশালী ব্যক্তি।
আজ অথবা আগামীকাল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তাদের খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিশনে। এই প্রতিবেদনে যে আটজনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া, সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালিস, রমেশ সাহা, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক পরিচালক মো. ঈসমাইল এবং নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একমের স্থানীয় সাব-এজেন্ট ড. গোলাম মোস্তফা। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন না হওয়া পর্যন্ত মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে এই আটজনই থাকবেন নাকি আরো নামের সংযোজন-বিয়োজন ঘটবে, সেটা নির্ভর করছে আজ দুদক ও বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকের ওপর। দুদকের বিভিন্ন সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
গতকাল লুই গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পোর নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে দুদক কর্মকর্তাদের দেড় ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। জানা গেছে, এ বৈঠকে দুদকের একটি পক্ষ সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে কোনোভাবে মামলার বাইরে রাখা যায় কি না, সে বিষয়ে নানাভাবে বিশ্বব্যাংক প্যানেলকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
দুদকের অনুসন্ধানী দলের খসড়া প্রতিবেদনে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তাতে বাংলাদেশের আইনে এ দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না- এমন কথাও প্যানেলের কাছে উত্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে। এ নিয়ে নানা যুক্তিতর্কও চলে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অনড় অবস্থানের কারণে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই গতকালের বৈঠক শেষ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, প্যানেলের বক্তব্য হচ্ছে, অনুসন্ধানী টিমের প্রতিবেদনে যেহেতু সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসানের সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে এসেছে, তাই তাঁদেরও মামলায় জড়াতে হবে।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হয়েও দুর্নীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং তাঁর কম্পানি সাকো কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে আঁতাত করে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী লবিস্ট হিসেবে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম ও কাজী আনিস দায়িত্বে অবহেলার কারণে অভিযুক্ত হতে পারেন। সচিব মোশাররফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কাজ পাইয়ে দিতে বারবার মূল্যায়ন কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করে এসএনসি-লাভালিনকে কাজ দিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে দুদক সূত্র জানায় এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে 'ষড়যন্ত্রে' জড়িতদের তালিকায় কতজনের নাম রয়েছে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, 'প্রতিবেদনে ১০ জনের কম ব্যক্তির নাম রয়েছে। অনুসন্ধান টিম প্রতিবেদন জমা দিলেও তার মূল্যায়ন এখনো শেষ হয়নি। তবে অতি দ্রুত আপনারা জেনে যাবেন কাদের মামলায় আসামি করা হচ্ছে।' তিনি আরো বলেন, এই প্রকল্পে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিন্তু লেনদেন হয়নি। অর্থ বিনিময়ের চেষ্টা কিংবা আলোচনা হয়েছে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে মামলায় জড়ানো হবে কি না, তা নিয়ে ব্যাপক যুক্তিতর্ক চলে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দুদক ও বিশ্বব্যাংক প্যানেল। তবে দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্যানেল সদস্যদের নৈশভোজের কর্মসূচিতেও এসব নিয়ে আলোচনা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে সূত্র মতে, গতকাল বৈঠকের শেষ পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সদস্যরা জানিয়ে গেছেন, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা না হলে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন আসবে না।
দুদকের অনুসন্ধান পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাংক প্যানেল দ্বিতীয় বারের মতো বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। তিন সদস্যের এই প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো। দুই সদস্য হলেন হংকংয়ের দুর্নীতিবিরোধী স্বাধীন কমিশনের সাবেক কমিশনার টিমোথি টং ও যুক্তরাজ্যের গুরুতর প্রতারণা দমন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক রিচার্ড অল্ডারম্যান। গত রবিবার দুদকের সঙ্গে প্যানেলের প্রথম বৈঠক হয়। গতকাল দ্বিতীয় দফা বৈঠকে সফররত প্যানেলের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইনও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দুদকের অনুসন্ধানীদলের চার কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন দুদকের সিনিয়র উপপরিচালক আবদুল্লা-আল-জাহিদ, মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী, গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী ও উপপরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গতকাল দ্বিতীয় দফা বৈঠক হলেও পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও দুদক একমত হতে পারেনি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আজ আবারও বৈঠকে বসবে তারা। এ বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছে দুদক। দুদকের অনুসন্ধানদল সূত্রে জানা গেছে, গতকালের বৈঠকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৩০ জনের বেশি ব্যক্তির জবানবন্দির কপি এবং অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্যানেল সদস্যদের কাছে তুলে ধরে তারা।
মামলার সুপারিশ করে কমিশনে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে, সে বিষয়টি কিভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেন, 'পদ্মা সেতু দুর্নীতির বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। আমরা এখনো আলোচনার মধ্যে আছি। আমি মনে করি, তদন্তের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বুধবার আমাদের আবারও বৈঠক হবে। বৈঠকের পর বিস্তারিত জানাতে পারব।'
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, অনুসন্ধানীদলের প্রতিবেদনে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ ও জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞদলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও এর মূল্যায়ন এখনো শেষ করতে পারেনি কমিশন। মূল্যায়ন শেষ না হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সময় নেওয়া হয়েছে। আজ বুধবার আবারও বৈঠক হবে।
দুদক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, অনুসন্ধানীদল যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে তাতে কী ধরনের দুর্নীতির চেষ্টা করা হয়েছে এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের একটি তালিকা ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়- এর সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আজ আবার বৈঠক হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিদ্ধান্তের পর আজ-কালের মধ্যে মামলা করা হবে বলে তিনি জানান।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের খসড়া পাওয়ামাত্র কমিশন পর্যালোচনা শুরু করে। এরপর বিকেলে দুদক ও বিশ্বব্যাংকের বৈঠকে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। তবে আইনি ব্যবস্থা কী হবে- তা নিয়ে তারা একমত হতে পারেনি। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে বিশ্বব্যাংক প্যানেলের সদস্যরা দুদক কার্যালয় ত্যাগ করেন। গতকাল বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে সেগুনবাগিচায় অবস্থিত দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আসেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.