বড়দের ধূমপান ছোটদের প্রভাবিত করে

১৩ নভেম্বর বিকেল পাঁচটায় ধানমন্ডি ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে পরামর্শ সহায়তা ৩২-এর আসর বসে। আসরে উপস্থিত ছিলেন মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল, আহমেদ হেলাল, মেখলা সরকার, সিফাত ই সাইদ, শেখর ব্যানার্জি ও ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল।
শুরুতে আহমেদ হেলাল সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে অভিভাবকদের ভুল ধারণা আছে। তাঁরা মনে করেন, বিয়ে দিলে, বেঁধে রাখলে, বিদেশ বা পাগলা গারদে পাঠালে রোগী ভালো হয়। এই ভুল ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মাদকাসক্ত রোগীকে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।
সমস্যা: আমার স্বামী ১৭ বছর ধরে মাদকাসক্ত। তিনবার চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন। আমি ঢাকায় থাকি। তিনি অন্য জেলায় চাকরি করেন। আমার কোনো কথা শোনেন না। এখন কী করতে পারি?
সমাধান: যেহেতু আপনার কথা শোনেন না, সে ক্ষেত্রে আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি, পরিবারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তাঁকে ভালো করার জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। তাঁর জন্য শঙ্কার বিষয় হলো, তিনি চাকরি করেন। মাস শেষে বেতনের টাকা পান। একা থাকেন। এটা মাদক গ্রহণের জন্য অনুকূল পরিবেশ। আপনার স্বামী পূর্ণমাত্রায় মাদকাসক্ত। এ অবস্থায় তাঁর পাশে আপনজনদের খুব প্রয়োজন।
সবার সহযোগিতায় তাঁকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে তিনি চাকরি করার সক্ষমতা হারাবেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাঁকে চিকিৎসা করানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
সমস্যা: আমার স্বামী মাদকাসক্ত। আমাদের একটি ছেলে আছে। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। তার মধ্যে তার বাবার আচরণ প্রভাব ফেলছে। বাসার মানুষদের সহ্য করতে পারে না। আমার ছেলেকে কীভাবে ভালো রাখতে পারব?
সমাধান: হ্যাঁ, এ রকম বিষয় আমরা লক্ষ করে থাকি। সাধারণত পরিবারে বড়দের ধূমপান ছোটদেরও প্রভাবিত করে। মনে হয়, বাবার আচরণ তার মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করি। এখন দেরি না করে ওকে শ্যামলী সরকারি মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। সেখানে বিনা পয়সায় প্রতি সোম ও বুধবার সকাল নয়টায় শিশুদের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ পরামর্শ আপনার সন্তানের জন্য খুবই উপকারী হবে।
সমস্যা: আমার সন্তান পাঁচ বছর ধরে মাদকাসক্ত। সে আর্কিটেক্টের ছাত্র। চিকিৎসার কথা বললে বাসায় চিকিৎসক আনতে বলে। সেমিস্টারের টাকা দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে মাদক গ্রহণ করে। টাকা না দিলে উত্তেজিত হয়ে ভাঙচুর শুরু করে। কীভাবে ওকে ভালো করতে পারি?
সমাধান: আপনি বলেছেন, আপনার সন্তান বাসায় চিকিৎসা নিতে চায়। এটি একটি ইতিবাচক দিক। অর্থাৎ তার ভালো থাকার ইচ্ছে আছে। কিন্তু মাদকাসক্ত রোগীরা অনেক সময় ইচ্ছে করলেও ভালো থাকতে পারে না। কারণ, তারা মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। মাদক না নিলে তাদের কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য ইচ্ছে না থাকলেও মাদক নিতে বাধ্য হয়। এখন আপনার কাজ হবে তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশা। কোনো প্রকার বিতর্কে না যাওয়া। তার ভালো মেধা, পড়াশোনাসহ যেসব ভালো কাজ আগে করেছে, সেগুলো নিয়ে প্রশংসা করতে থাকুন। তার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। সে যেন বুঝতে পারে, আপনি তার একজন ভালো বন্ধু। তার সব ব্যাপারে সহযোগিতা করার চেষ্টা করুন। তা হলে সে ধীরে ধীরে আপনার ওপর নির্ভরশীল হবে। একসময় দেখবেন, সে তার ব্যথা-বেদনার কথা সব খুলে বলছে। তখন তাকে বলবেন, ‘তুমি না একদিন নিরাময় কেন্দ্রে যেতে চেয়েছিলে। চিকিৎসা নিতে চেয়েছিলে। চলো যাই।’ এবার দেখবেন, সে আপনার কথা শুনবে। আশা করি, তখন তাকে চিকিৎসকের কাছে আনতে পারবেন এবং ভালো করতে পারবেন। আমরা যেভাবে বলি, এটিই শেষ কথা নয়। সর্বোপরি একজন মাদকাসক্ত রোগীর আচরণ কখন কী হবে, এর সবকিছু অভিভাবককে বুঝতে হবে এবং সেভাবে তার সঙ্গে আচরণ করতে হবে।
সমস্যা: আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। আমাদের একটি ছেলে আছে। নিরাময় কেন্দ্র থেকে ফিরে আবার মাদক নিচ্ছে। চিকিৎসা নিতে বললে বলে, ‘কোনো লাভ নেই। চিকিৎসার পর ফিরে এসে আবার মাদক খাব।’ এ অবস্থায় কী করার আছে?
সমাধান: বিভিন্ন করণে মানুষ নেশা করে। দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে, কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নেশা করে। ভালো থাকার উপযোগী পরিবেশ না পেয়ে নেশা করতে বাধ্য হয়। নেশা করার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি একজন মাদকাসক্ত মানুষ যখন ভালো হয়ে ফিরে আসে, তখন তার প্রতি পরিবারের অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায়। তাকে ভালো রাখার জন্য পরিবারের সবাইকে কাজ করতে হবে। এ বিষয় একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। রোগীর প্রতি অনেক সহমর্মী হতে হবে। যে সময় তার মানসিকতা ভালো থাকে, তখন তার জীবন, সংসারের প্রতি দায়িত্ব—এ দিকগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে বোঝাতে হবে। আপনাদের একটি ছেলে আছে। প্রত্যেক বাবা তাঁর সন্তানকে অনেক ভালোবাসেন। বাবার এই আচরণ দেখে এ সন্তানের জীবনও একদিন বিপন্ন হবে। এ কথাটি তাকে বোঝাতে হবে। কোনো মাদকাসক্ত রোগীর জন্য একা কাজ করা কঠিন। আমরা বারবার বলে থাকি, মাদকাসক্ত রোগীদের গোপন করার কিছু নেই। তার ব্যাপারে সবার সঙ্গে খোলামেলা হতে হবে। পরিবারের অন্যদেরও তাকে ভালো করার জন্য সম্পৃক্ত করতে হবে; যদিও বলে, চিকিৎসার পর আবার খাবে। মাদকাসক্ত রোগীরা এমন বলে। ভালোভাবে চিকিৎসা নিলে এবং দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে আর মাদক গ্রহণ করবে না।
প্রশ্ন: মাদকাসক্ত রোগীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে?
উত্তর: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মাদকাসক্ত রোগীরা অন্য রোগীদের মতো নয়। তারা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। মাদক তাদের পরিচালিত করে। অভিভাবকেরা সন্তানদের আচরণে খুব কষ্ট পান। কিন্তু এটা তার নিজস্ব আচরণ নয়। মাদক গ্রহণের ফলে দিনের পর দিন এমন হয়ে গেছে। ফলে তার সঙ্গে অনেক দেখে-শুনে, ভেবেচিন্তে আলোচনা করতে হয়।
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের সরাসরি কখনো মাদক ছাড়ার কথা বলা যাবে না। তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে করতে একসময় সে ভালো হওয়ার কথা বলবে। তখন তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকাসক্ত রোগীর ক্ষেত্রে আর যা-ই হোক বকাঝকা করে ভালো পথে আনা যাবে না।
প্রশ্ন: নিরাময়কেন্দ্র থেকে বেরোলেই কি চিকিৎসা শেষ হয়ে যায়?
উত্তর: অনেক অভিভাবক ও রোগী মনে করে, নিরাময়কেন্দ্র থেকে বেরোলে তাদের চিকিৎসা শেষ। এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। একজন মাদকাসক্ত রোগীকে পরিপূর্ণ ভালো হতে হলে দুই বছরের অধিক সময় লাগে। নিরাময়কেন্দ্রে তাকে মাদক দেওয়া হয় না। অন্যদিকে মাদকের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ফলে নিরাময়কেন্দ্রে ভালো থাকে। দু-তিন মাস নিরাময়কেন্দ্রে রাখলে কখনোই চিকিৎসা শেষ হয় না। বাইরে মাদক গ্রহণের নানা ধরনের সুযোগ রয়েছে। নিরাময় কেন্দ্রে এ সুযোগ থাকে না। ফলে নিরাময়কেন্দ্রে মাদকমুক্ত থাকার প্রক্রিয়া শুরু হয় মাত্র।
প্রশ্ন: মূল চিকিৎসার বিষয়টি কি বুঝিয়ে বলবেন?
উত্তর: মূল চিকিৎসা নিরাময়কেন্দ্রের বাইরে। নিরাময়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দু-তিন বছর চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া। আগে যেসব বন্ধুর সঙ্গে মাদক গ্রহণ করা হতো, সাহসের সঙ্গে তাদের ‘না’ বলা। তাদের ভালো করার চেষ্টা করা। ভালো করতে না পারলে বন্ধুদের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে না মেশা। যেসব জায়গায় গেলে মাদক খেতে ইচ্ছে করে, সেসব জায়গায় না যাওয়া। টাকা দেখলে মাদকের কথা মনে পড়ে। টাকাপয়সা থেকে নিজেকে দূরে রাখা। মুঠোফোন দেখলে পুরোনো বন্ধুদের ফোন করতে ইচ্ছে করে। মাদকের কথা মনে পড়ে। দু-তিন বছর মুঠোফোন ব্যবহার না করা। সৃষ্টিশীল কাজ করা। নিরাময় কেন্দ্র থেকে বেরোলাম আর ভালো হয়ে গেলাম—এটা খুবই সস্তা ধারণা। নিরাময়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে উপরিউক্ত পদ্ধতিগুলো না মেনে কেউ ভালো হয়েছে বলে জানা নেই।
প্রশ্ন: যেকোনো নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি করলে কি রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পায়?
উত্তর: মাদকাসক্ত রোগীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা কিছু ভুল কাজ করেন। যেমন: মাদকাসক্তের বিষয়টি অভিভাবকদের মধ্যে গোপন করার প্রবণতা দেখা যায়। গোপন করতে করতে রোগী একসময় চরম সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। তখন তাড়াহুড়া করে হাতের কাছে যেটা পান, সেখানে ভর্তি করে দেন। এ কারণে রোগীর অবস্থা আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। এ জন্য মাদকাসক্ত রোগীদের সঙ্গে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হয়। যাতে সবাই খোঁজখবর নিয়ে রোগীকে একটি ভালো জায়গায় ভর্তি করাতে পারেন। কারণ, দেশে অনেক নিরাময়কেন্দ্র আছে। তাদের সবার মান সমান নয়। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়, রোগী নিরাময়কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার অবস্থা অগের তুলনায় অনেক বেশি খারাপ। এ জন্য অবশ্যই নিরাময় কেন্দ্রে রোগী ভর্তি করার আগে তাদের সেবার গুণগত মান যাচাই করে ভর্তি করতে হবে।
সমস্যা: আমি মাদকাসক্ত ছিলাম। নিজেই নিরাময়কেন্দ্রে গিয়েছি। এখন কিছুদিন ধরে ভালো আছি। মাঝেমধ্যে আমার মাদক গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে। কীভাবে মাদক থেকে দূরে থাকতে পারি?
সমাধান: আপনার পরিবেশ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন: বন্ধুদের মাদক নিতে দেখলে, মাদকের গন্ধ পেলে, মাদকের ছবি দেখলে, মাদক খাওয়ার জায়গাগুলোতে গেলে আবার মাদক নিতে ইচ্ছে করবে। বিশেষ কোনো দিনে, বিশেষ কোনো সময় নিতে ইচ্ছে করবে। সে সময়ে আপনি পরিবারের সদস্যদের বলবেন, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কোনো ব্যায়াম করতে পারেন। সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করতে পারেন। নিজের মনকে শক্ত রাখবেন। আগের বন্ধুদের সব সময় এড়িয়ে চলবেন। আপনার খাওয়াদাওয়া, ঘুম—এসব ব্যাপারে নিয়ম মানতে হবে। জীবনযাপন বদলে ফেলতে হবে। ভালো বই পড়বেন। মানুষের সেবা করার চেষ্টা করবেন। সর্বোপরি নিজেকে কোনো না-কোনো কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখবেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন মাদকবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী ফেরদৌস ফয়সাল।
 গ্রন্থনা: আশফাকুজ্জামান

No comments

Powered by Blogger.