মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক যোগমায়া by কাজী সুফিয়া আখতার

 মুজিবনগর সরকারের অধীনে হাসনাবাদ ক্যাম্প স্কুলের শিক্ষক ছিলেন যোগমায়া সাহা রায়। বাবা নিত্যানন্দ সাহা রায়। আট বোন, এক ভাই। রায়ের পূর্বপুরুষ রাজৈরের সাহা পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার পড়ালেখার হাতেখড়ি। গোপালগঞ্জ কে. জে. এস. ইনস্টিটিউট থেকে এসএসসি পাস করেন।
নাজিমুদ্দিন কলেজ থেকে আইকম ও বিকম পাস করেন। এ সময় রাজৈর থানার ওসি হিসেবে সৈয়দ আহমদ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি স্থানীয় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে রাজৈর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। যোগমায়ার কাছে স্কুলে যোগদানের প্রস্তাব এলো। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা নেই। টিনশেড ঘরে ৮-১০ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯৭০ সালে শুরু হলো রাজৈর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পথযাত্রা। ১৯৭১ সালের মার্চের শেষ দিকে রাজৈর বালিকা বিদ্যালয়ের পাশেরা মাঠে গ্রামের যুবকদের প্রশিক্ষণ দান শুরু হয় রাজৈর থানার সহযোগিতায়। যোগমায়া সাহা রায় প্রায় প্রতিদিনই সেখানে হাজির হতেন। গাছের ডাল বন্দুক বানিয়ে কাঁধে ফেলে লেফ্ট-রাইট, লেফ্ট-রাইট। ২৫ মার্চের কালরাতের পর রাজৈর থানার আমগ্রাম ইউনিয়নের পাখুল্যা গ্রামে বাবু রাসমোহন বালার বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প খোলা হলো। যোগমায়া বোনদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে এপ্রিল থেকে জুন মাস অবধি ছিলেন। তার কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের রান্নার জোগাড় ও খাবার পরিবেশন এবং অসুস্থদের সেবা করা। এক সময় ক্যাম্পটি পাকসেনাদের দখলে যায়। মুক্তিবাহিনীর ৩২ জনের একটি দলের সঙ্গে যোগমায়ার পরিবার ভারতে চলে যায়। রাজনীতিবিদ ফণীভূষণ মজুমদারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি হাসনাবাদ ক্যাম্প স্কুলে যোগমায়া সাহা রায়কে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে যোগমায়া সাহা রায় রাজৈর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী পদে যোগদান করেন। ৮-১০ জন ছাত্রী নিয়ে পথচলা। তারপর প্রতি বছর ছাত্রীসংখ্যা বাড়তে থাকে। আজ রাজৈর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবন সবার নজর কাড়ে। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত ছাত্রীনিবাস। উন্নত পাঠাগার। ছাত্রীসংখ্যা প্রায় এক হাজার। এই স্কুলে ছাত্রীদের পাসের হার বরাবরই ভালো। মানবিক, বিজ্ঞান, বাণিজ্যের সঙ্গে কারিগরি বিভাগও আছে। একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ। অথচ এই স্কুল নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। আশির দশকে একবার একদল লোক এই বালিকা বিদ্যালয়কে মাদ্রাসা বানানোর পাঁয়তারা করেছিল। তারপর তাকে প্রধান শিক্ষয়িত্রীর পদ থেকে সরানোর হীন প্রচেষ্টাও চলে। কিন্তু সৎ, নিষ্ঠাবান যোগমায়া সাহা রায় সদাসচেষ্ট থাকেন স্কুল ও মেয়েদের শিক্ষার মান উন্নয়নে। গত প্রায় চার দশকে এই স্কুল থেকে কমপক্ষে আড়াই হাজার ছাত্রী এসএসসি পাস করেছে।
স্বাধীনতার চলি্লশ বছর পূতি হলো। আজও যোগমায়া সাহা রায় তার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র পাননি। পরোপকারী এই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং সনদপত্র পাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সব প্রয়োজনীয় সনদপত্র-প্রত্যয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা_ এই সত্যটি রাজৈর উপজেলার সবাই জানেন। জন্ম থেকে শৈশব, কৈশোর ছাড়িয়ে কর্মজীবন, সংসার_ সবই রাজৈরের ভূমিতে। এসব সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম নেই। শিক্ষার মান বিষয়ে আপসহীন, নিষ্ঠাবান শিক্ষক খুব কম দেখেছি। স্নেহবৎসল এই শিক্ষকের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান স্কুলের উন্নয়ন। নীতিতে কঠোর, ব্যবহারে অমায়িক, সহজ-সরল জীবনযাপনে বিশ্বাসী এই শিক্ষক, এই মুক্তিযোদ্ধা যোগমায়া সাহা রায় তার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কবে পাবেন?
 

No comments

Powered by Blogger.