তিন প্রজন্ম- পথের পিঠা পথের পসার by রয়া মুনতাসীর

দ্রুত, খুব দ্রুত হাতে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছেন আয়েশা। পাশে বসে মাকে সাহায্য করছেন শাহানা। শীতের বিকেল বলে কথা। গরম গরম পিঠা দেওয়ার জন্য ফরমাশ আসতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। চোখের পলকে বেড়ে গেল ব্যস্ততা। এরই মধ্যে জেনে নিলাম তাঁদের প্রতিদিনকার দুঃখ, হাসি, কান্নার গল্প।
মা, মেয়ে ও নাতনি। আয়েশা, শাহানা ও লিমা। তিনজনের ছোট্ট সংসার। এই তিন প্রজন্ম প্রতিদিন একে অপরের দুঃখ, কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। একইভাবে একে অপরের কাজে সাহায্য করে কিছুটা নিরাপত্তা আর সুখের দেখা পাওয়ার চেষ্টা করে। আয়েশা কাজ করতেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ার্ডে আয়া হিসেবে। কর্মক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা হওয়ার কারণে ২২ বছরের চাকরিজীবনের ইতি টানতে হয়। সে-ও প্রায় ১৯ বছর আগেকার কথা। পরিবারে আর্থিক কষ্টের আনাগোনা তখন থেকেই। স্বামী মারা গেছেন প্রায় দুই যুগ হয়ে গেছে। বুঝলেন, কেঁদে দিন পার করলে হবে না। অতঃপর সংসারের বইঠা একলা হাতেই তুলে নিলেন আয়েশা। পরিবারে দুই ছেলে, এক মেয়েকে ভালো একটি জীবন দিতে চেয়েছিলেন। শুরু হলো নতুনভাবে পথচলা। বাড়িতে বাড়িতে ব্লাউজ, পেটিকোট, টুকরা কাপড় নিয়ে যেতেন। কিন্তু খুব বেশি বিক্রি হতো না। পেশা পাল্টালেন। এরপর ফুটপাতে সারা দিন সবজির টুকরি নিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু সংসারে সচ্ছলতা আনতে পারেননি। ‘এই হাসপাতালের (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) কয়েকজন মানুষ সাহায্য করছিল, নাইলে পান-সুপারির দোকানডা দিতে পারতাম না। ১০ বছর ধইরা এই মেডিকেল কলেজের সামনেই দোকান চালাইতাছি। আমার মাইয়াও বসে আমার লগে। এখন সবাই আমারে চাচি বইলাই ডাকে। আশপাশের সব্বাই যতটা সম্ভব সাহায্য করে।’ জানান আয়েশা।
শাহানা বেশি পরিচিত ‘আপা’ নামেই। এ বছরই মায়ের সঙ্গে ভাপা ও চিতই পিঠা বিক্রি শুরু করেছেন। উদ্দেশ্য, যদি দুই-চার টাকা বেশি আয় করা যায়। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর মায়ের সঙ্গেই থাকেন তিনি। দুই মেয়ে সুমি ও লিমাকে বড় করে তুলেছেন মায়ের উপার্জনেই। মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হেরে যেতে হয়েছে টাকার কাছেই। মায়ের কষ্ট, মেয়েদের সুন্দর একটি জীবন না দিতে পারার ব্যর্থতা, নিজের জন্য হতাশা—সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে ওঠে চোখের পানিতে। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, ‘ভাইয়েরা আমারে দেখতে পারে না। আমার দোষ, আমি মায়ের লগে থাকি। তার টাকায় আমার মেয়েগুলান বড় হইতেছে, এইডা ওগো সহ্য হয় না। এই জন্যই নিজেরা বিয়া কইরা বউ নিয়া আলাদা হইয়া গেছে।’
মা-নানির দুর্দশা দেখেই বড় হয়েছে লিমা। বড় বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে পাল্লা দিয়ে সংসারের কাজ করছে। এই শীতের শুরু থেকে নানি ও মায়ের দিকে লিমাও বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। মা ও নানি যখন পিঠা বিক্রি করেন, লিমা তখন পান-সুপারির দোকান সামলায়। এক সপ্তাহের ভেতরেই অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিবারকে সাহায্য করতে পেরে সে খুব খুশি। কিন্তু বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত একই জায়গায় বসে থাকাটা কষ্টকর। খুব একটা ভালো লাগে না। একটু নিচু স্বরেই কথাটা বলল লিমা। মা-নানি শুনলে কষ্ট পেতে পারেন।
প্রতিদিন তো পাঁচ থেকে সাত কেজি মালমসলা দিয়ে পিঠা বানানো হয়। পথচারীরা বেশ মজা করেই খায়। তো বাড়িতে সেই পিঠা বানিয়ে খেতে কেমন লাগে? উত্তরে আয়েশা চাচি ছোট্ট করে বললেন, ‘এত ট্যাকা তো পাই না যে বাড়িতে একটু আরাম কইরা পিঠা বানায় খামু। মাঝে মাঝে যে তিনবেলা ঠিকমতন ভাত খাইতে পারি, হেইডাই তো ভাইগ্য।’

No comments

Powered by Blogger.