সব সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে! by সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ

কী আশ্চর্য! কী নির্মম পরিহাস! ১০ মাসের মধ্যে কত কিছু উলটপালট হয়ে গেল। জুবায়েরকে যারা খুন করেছিল, 'ভিসি লীগে'র সেই ক্যাডাররা বীরদর্পে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে (১৮ নভেম্বর ২০১২, সমকাল)। এ খবর জাহাঙ্গীরনগরের জন্য বেশ বেদনার।
খবর পত্রিকার পাতায় অনেক পরে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এরও অনেক আগে খুনিরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের 'কল্যাণে' জুবায়েরের খুনিরা এখন ক্যাম্পাসে নিরাপদ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কাউকেই তেমন উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রশাসন কাউকেই না। ওই ছাত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিয়েছেন। সুতরাং নেতৃত্বের বদল ঘটেছে বিভিন্ন সংগঠনে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেও নেতৃত্বের বদল ঘটেছে। ক্যাম্পাসে সেই উপাচার্যও এখন আর নেই। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই উদ্যোগী ভূমিকা পালন না করা দুঃখজনক। মরণপণ আন্দোলনের পর এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই কেউ দেখতে চাইবে না। কিন্তু পত্রিকার খবর মতে, প্রত্যক্ষ দর্শকের মতে, জাহাঙ্গীরনগর সেই বেদনা সইছে! শুধু তাই নয়, তারা খুন-খারাবির অপরাধে যে পরীক্ষাগুলো দিতে পারেনি, সেগুলোতে অংশগ্রহণ করে মোক্ষম 'বাঘের চোখ' সনদপত্রটাও নিশ্চিত করে ফেলার চেষ্টায় রয়েছে!
সমকালের সেদিনের প্রতিবেদনে জুবায়েরের বড় ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন_ 'জুবায়ের হত্যার বিচার প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশের নির্দেশ দিলেও এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আপিল না করার সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবোধক।' অন্যদিকে বিডিনিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে (১৭ নভেম্বর ২০১২) উদ্ধৃত করে বলেছে, 'প্রক্টরিয়াল বডির বিশেষ তত্ত্বাবধানে তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। কিন্তু হলে কিংবা ক্যাম্পাসে অবস্থান নিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' জুবায়েরের বড় ভাই যা বলেছেন উপাচার্যের বক্তব্য সেটাকেই পরোক্ষে সমর্থন করেছে। হলে কিংবা ক্যাম্পাসে অবস্থান নিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কেন? অপরাধীরা তো সেই 'ব্যবস্থা' করেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। বরং সেই 'ব্যবস্থা'কে রুখে দিতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়াটাই হতো যুক্তিযুক্ত।
অনেকেই হয়তো দায়িত্ব এড়াতে নির্বিকার থাকতে পারে। কিন্তু প্রশাসনের এ ব্যাপারে নির্বিকার থাকা অধিকতর নিন্দনীয়। এর কারণ দুটি। প্রথমত, জুবায়ের খুন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি মামলা দায়ের করেছিল। রাষ্ট্রীয় আইনে বিচারের যে দাবি আন্দোলকারীদের ছিল এটা তারই অংশ। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রক্রিয়া চলা অবস্থাতেই আসামিরা জামিন পেয়েছে। কিন্তু বিচার কাজ দ্রুততম সময়ে শেষ করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাষ্ট্রের কাছে যথাযথ দাবি নিয়ে হাজির হতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, খুনিদের শাস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে নিশ্চিত হয়েছে। সিন্ডিকেটের সেই সিদ্ধান্তটিতে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ থাকলেও তারা তা করেনি। আইনের দরজা তো তাদের জন্যও খোলা। নিজেদের করা মামলা এবং সিন্ডিকেটে দেওয়া রায়ের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা-কাঠামোর যেন নিদারুণ অনাস্থা!
যাই করা হোক না কেন, অপরাধীরা ক্ষমাযোগ্য হয়ে উঠলে তা খুবই বাজে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপিত হবে। স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য এটা কোনো সুখের কথা নয়। এটা তো সত্য যে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শাস্তি পেয়েছে তাদের অনেকেই এই হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধেই তো জাহাঙ্গীরনগর সোচ্চার হয়েছিল। তাহলে কি সেই দেশ কাঁপানো আন্দোলন মিথ্যা? জুবায়ের হত্যাকাণ্ড মিথ্যা? সেই অপরাধ মিথ্যা? এভাবে সব সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে?
sc.joydip@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.