নির্বাচন-যে সমর্থন ভুল বার্তা দিতে পারে by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

তসলিমা কোনো দিন ভারতের রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা ঘামাননি। তাহলে এত বছর পর হঠাৎ তিনি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ঠিক আগের দিন এমন এক রাজনৈতিক বিতর্কে মাথা ঘামালেন কেন? এটা কি নিছকই একজন নারীবাদীর অন্য এক নারী নেত্রীর প্রতি সম্মাননা, না অন্য কিছু?
না, পশ্চিমবঙ্গে থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে তাকে যেভাবে তার 'সাধের' কলকাতা ছাড়তে হলো, সেই ঘটনার পরোক্ষ বদলা নেওয়ার জন্যই মমতাকে হঠাৎ সমর্থন?


পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কে_ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? এই প্রশ্নে বুদ্ধিজীবী, খেলোয়াড় ও শিল্পমহল তোলপাড়। অবশ্য সাধারণ মানুষের এ নিয়ে কোনো হেন দোল নেই। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ কাকে ভোট দেবেন, ভোটের আগে বড় একটা কাউকে জানান দিতে চান না। ভোট নিয়ে যা মাতামাতি তা মিডিয়াই করে। কলকাতার একটি বিখ্যাত দৈনিক একটি বাণিজ্যিক সংস্থার সাহায্যে এক সমীক্ষা চালিয়ে ইতিমধ্যেই বাজার গরম করে ফেলেছে। তাদের সমীক্ষা অনুসারে এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে ২৯৪টির মধ্যে ২৩৫টি আসন পাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জোট। যার মধ্যে কংগ্রেস লড়ছে ৬৪টি আসনে আর অতিবাম দল সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার পাঁচটি আসনে। আগেরবারই পাঠকদের জানিয়েছিলাম, জয় সব মিডিয়াই ধরে নিয়েছে, মমতাই মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন।
একদল বুদ্ধিজীবী, ফিল্মস্টার ও খেলোয়াড় তার হয়ে প্রচারে নেমেছেন। কেউ কেউ মমতার নমিনেশনে নির্বাচনেও লড়ছেন।
তাদের দলে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন। গত ১৭ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতাতেই একটি স্বাক্ষরিত লেখায় ভোটযুদ্ধে মমতার হয়ে আত্মপ্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তসলিমা। মমতার সমর্থনে খুব ভালো ভালো সার্টিফিকেট দিয়ে তার লেখাটি শুরু করেছেন এইভাবে : 'পশ্চিমবঙ্গে ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসছে বলে শুনছি, তার স্বাদ হয়তো আমাকে রাজ্যের বাইরে থেকে নিতে হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যে বাস করা কোনো মানুষের চেয়ে উত্তেজনা আমার কিছু কম নয়। হাওয়ার জোর থাকলে সে হাওয়া অনেক দূর পেঁৗছায়। রাজনীতি আমি খুব বেশি বুঝি না। তবে চারদিক দেখেশুনে এই বিশ্বাস আমার জন্মেছে, ৩৫ বছর ধরে যে বাম শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে, শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মহীরুহের শক্ত শিকড় উপড়ে ফেলেছেন। অসীম ক্ষমতাধর পুরুষ নেতারা যা পারেননি, তা একজন সহজ-সরল সাধারণ নারী পারছেন।
তসলিমা মনে করেন, 'আমার আশা এবং স্বপ্ন, মমতা ক্ষমতায় এসে মেয়েদের যৌনদাসত্ব ঘোচাবেন।'
তসলিমা গত দু'বছর আগে পর্যন্ত কলকাতায় একটি ফ্ল্যাট নিয়ে বাস করছিলেন। যত দিন না তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেন, ততদিন তিনি কলকাতাতেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন। ভারত সরকারেরও হয়তো তাতে আপত্তি হতো না যদি না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক অংশ তাকে কলকাতা ছাড়ার জন্য তীব্র জঙ্গি বিক্ষোভ দেখাতে শুরু না করত। তখন বর্তমান রাজ্য সরকার তাকে প্রটেকশন দিতে অপরাগ বলে কেন্দ্র স্বরাষ্ট্র বিভাগকে জানায়। গোঁড়াপন্থিদের বিক্ষোভের মুখে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশেষ বিমানে তার এক বস্ত্রে কলকাতা ছেড়ে রাজস্থানের এক অজ্ঞাত এলাকায় তসলিমাকে পাঠিয়ে দেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার। তারপর ভারত সরকারও চাপে পড়ে তসলিমাকে দীর্ঘদিনের মেয়াদে ভিসা দিতে রাজি হয়নি। ফলে ভারত থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে তসলিমা প্যারিসে থাকেন, কখনও দিলি্লতে থাকেন।
ভারতের সাধারণ মানুষের ওপর তসলিমার যে সেই অর্থে প্রভাব আছে, তা নয়, তবে পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার লড়াকু মানসিকতার অনেক সমর্থক আছেন। তসলিমা নিজেকে বামপন্থি বলেন। বাম সরকার 'ভোটব্যাংক' হারানোর ভয়ে তসলিমাকে পশ্চিমবঙ্গছাড়া করে; কিন্তু বাম ও অবাম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তসলিমার ভক্ত অনেক আছেন। পশ্চিমবঙ্গে তার বইয়ের বিক্রি ভালোই।
কিন্তু কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে এই প্রশ্নটি উঠেছে, তসলিমা কোনো দিন ভারতের রাজনৈতিক ব্যাপারে মাথা ঘামাননি। তাহলে এত বছর পর হঠাৎ তিনি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ঠিক আগের দিন এমন এক রাজনৈতিক বিতর্কে মাথা ঘামালেন কেন? এটা কি নিছকই একজন নারীবাদীর অন্য এক নারী নেত্রীর প্রতি সম্মাননা, না অন্য কিছু? না, পশ্চিমবঙ্গে থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে তাকে যেভাবে তার 'সাধের' কলকাতা ছাড়তে হলো, সেই ঘটনার পরোক্ষ বদলা নেওয়ার জন্যই মমতাকে হঠাৎ সমর্থন? আনন্দবাজার পত্রিকাইবা এতদিন পর হঠাৎ প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে এত গুরুত্ব দিয়ে এ খবরটি ছাপাল কেন? মমতার ইতিমধ্যে যা জনসমর্থন তাতে তসলিমা তাকে সার্টিফিকেট দিলেন কি দিলেন না, তাতে কিছু এসে যায় না। বরং পশ্চিমবঙ্গের মৌলবাদী মুসলিম ভোটারদের কাছে তসলিমার এই মমতা সমর্থন ভুল বার্তা পেঁৗছতে পারে।
তবে তসলিমার এই সমর্থন রাজ্যের ভোটযুদ্ধে এক নতুনমাত্রা এনে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগেই মমতা এখন সর্বভারতীয় স্তরে যেভাবে মিডিয়াতে প্রচার পাচ্ছেন তা সত্যিই অভূতপূর্ব। এবার পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আরও কয়েকটি বিধানসভার নির্বাচন হচ্ছে। যেমন আসাম, তামিলনাড়ূ, কেরালা। ওইসব রাজ্যেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা কমবেশি প্রবল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন নাটকীয়তায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে একজন রাজনীতির অধ্যাপক বললেন, পশ্চিমবঙ্গে বামেরা এতদিন মনে করত তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ছলে-বলে কৌশলে নির্বাচনে জয়লাভের ম্যাজিক তারা জানে বলে দাবি করত। সিপিএমদের সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই করতে গিয়ে গত ৩৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মমতাও একাধিকবার আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু মমতা তার লড়াইকে কোনোদিনও গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করতে পারেননি। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মানে মৃত্যু। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর সাধারণ মানুষের মনে 'সিপিএম জুজুর' ভয়টা কেটে গেছে। এখন মমতা যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে কাতারে কাতারে লোক হচ্ছে। তাছাড়া কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার এতদিন রাজ্যের সিপিএম সরকারের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেনি। এবার সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী, মনমোহন সিং এমনকি সিপিএমের প্রতি এতদিন সহানুভূতি পোষণ করতেন যিনি সেই প্রণব মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত কোমর বেঁধে নেমেছেন বামফ্রন্টকে হটানোর জন্য। তাছাড়া এবার জনপ্রিয় কবি, লেখক, চিত্রতারকারা মমতার সমর্থনে নেমে পড়েছেন। নায়ক চিরঞ্জীব, নায়িকা দেবশ্রী রায় তো তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। গায়ক অনুপ ঘোষাল, নাট্যব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু, তৃণমূল প্রার্থী। কবি জয়গোস্বামী ও লেখিকা মহাশ্বেতাদেবী মমতার পক্ষে লিখছেন। নাটক ও মঞ্চের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এখন মমতার দিকে। তবে বামফ্রন্টের সমর্থনে এখন সরব আছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তবে এবার কোনো বুদ্ধিজীবী লেখক-শিল্পী-কবি বামফ্রন্টের টিকিটে দাঁড়াননি।
দেখতে দেখতে নির্বাচনের দিনক্ষণও ঘনিয়ে এলো। দফায় দফায় হবে নির্বাচন। সোমবার ১৮ এপ্রিল থেকে শুরু। ফলাফল বেরুবে ১৩ মে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নির্বাচন যেমন ঘটা করে শুরু হয়, শেষও হয় সরকারি আইন-কানুন মেনে, যথাসময়েই। কিন্তু এই নির্বাচন যে সবসময় অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে হয় তা বলা যায় না। কোথাও উগ্রপন্থিরা নির্বাচকদের ভয় দেখিয়ে ভোট পণ্ড করে দেওয়ার জন্য গুলিগোলা নিয়ে হামলা চালায়। কোথাও শক্তিশালী দল হামলা চালিয়ে বুথ দখল করে ছাপ্পা ভোট দেয়। ছাপ্পা ভোট মানে হলো, একটি দলের সমর্থনে হামলাকারীরা ভোটপত্রে ছাপ মেরে দেয়। এজেন্টদের বুথ থেকে তাড়িয়ে দেয়। এখন অবশ্য বোতাম টিপে ভোট হয়। বোতাম অবশ্য রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা টিপে দেয় নিজেদের প্রার্থীদের পক্ষে। কোথাও নির্বাচনে প্রকাশ্যেই চলে ভোট কেনাবেচা। এবার ভোটে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন চেয়েছে যাতে অতীতের পুনরাবৃত্তি না হয়। এ জন্য প্রথমেই তারা ভোটের বাজারে কালো টাকা যাতে উড়তে না পারে তার জন্য কতগুলো ব্যবস্থা নেন। যেমন আয়কর দফতর নজর রাখতে শুরু করে ভোটের আগে কেউ ব্যাংক থেকে মোটা টাকা তুলছেন কি-না অথবা নগদ টাকার থলি নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন কি-না। প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ঊর্ধ্বসীমাও বেঁধে দেওয়া হয়। আয়কর দফতর পশ্চিমবঙ্গে মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছ'জনের কাছ থেকে সাড়ে চার কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করে। তারা ওইসব টাকা কাউকে না কাউকে দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ওই টাকা কোথা থেকে পেলেন তার সদুত্তর দিতে পারছিলেন না।
এবারের নির্বাচনে প্রশাসন কার্যত চলে গেছে নির্বাচন কমিশনের হাতে। তাই নির্বাচনের মুখে রাজ্য পুলিশ আগের মতো একতরফাভাবে কিছু করতে পারছে না। কাউকে গ্রেফতার করতে হলেও নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিতে হবে। আর নির্বাচন কমিশনের আদেশ নত মস্তকে শুনতে হবে। নির্বাচনের সময় রাজ্য পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের এতদিনের ভূমিকা খুব নিরপেক্ষ ছিল না। পুলিশ সরকারের বশংবদ ভৃত্যে পরিণত হয়েছিল। ভোটের দিন পুলিশ বিরোধীদের কোনো অভিযোগে পারতপক্ষে কান দিত না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন, বামফ্রন্ট সরকার ভোটে কারচুপি করে জিতে এসেছে। আর সেই কারচুপিতে তার মূল সহায় ছিল পুলিশ। সম্প্রতি তৃণমূল নেতা, মমতার ডান হাত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ের ছেলে শুভ্রাংশু কলকাতার কাছেই বীজপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রার্থী হয়েছেন। এই কেন্দ্রে বেআইনিভাবে লটকানো তৃণমূলের ফেস্টুন ও পোস্টার খুলে দিচ্ছিলেন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সরকারি অফিসার। মন্ত্রীপুত্র শুভ্রাংশু দলবল নিয়ে সেখানে গিয়ে ওই অফিসারকে কাজে বাধা দেন। অভিযোগ, তিনি মারধরও করেন। তখন নির্বাচন কমিশন থেকে তৃণমূল প্রার্থী শুভ্রাংশুর নামে এফআইআর করা হয় ও মন্ত্রীপুত্রকে গ্রেফতার করার জন্য ভারপ্রাপ্ত আইসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু থানার আইসি ওই গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করতে গড়িমসি করেন। কারণ দেখান, অভিযুক্ত আসামি আত্মগোপন করেছেন। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বামফ্রন্ট জমানায় বামফ্রন্টের বিভিন্ন নেতাকর্মীর নামে এমন অসংখ্য ওয়ারেন্ট বেরিয়েছিল। কিন্তু আসামি নিখোঁজ দেখিয়ে সেসব কার্যকর করা হতো না। এবার ঠিক সেই জিনিসটিই ঘটল। তবে গ্রেফতারি পরোয়ানায় নামটি ছিল বিরোধী দলের একজনের।
নির্বাচন কমিশন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে ওই পুলিশ অফিসারকে সামপেন্ড করে দেয়। মন্ত্রীপুত্র পরে আত্মসমর্পণ করেছে।
অন্যবারের চেয়ে কম হলেও নির্বাচনী সংঘর্ষ যে এবারও হচ্ছে না তা নয়, তবে সংখ্যায় কম। তবে অন্যবার বিরোধীরা পাল্টা আক্রমণ করতে সাহস করত না, এবার তা হচ্ছে না। বরং তৃণমূলই বহু জায়গায় বেশি মারমুখী। অনেকে আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনী ফলাফল বের হলে হিংসা আরও ছড়াবে।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.