ড. ইউনূস ইস্যু আর কত দিন চলবে? by ডক্টর তুহিন মালিক

সরকার হলো এমন একটি শাসনযন্ত্র, যার মাধ্যমে কোনো একটি রাজনৈতিক এককের শাসন কর্তৃত্ব নির্বাহ হয়। একটি দেশের সরকার ওই এককটির নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও তার প্রজাদের শাসন ও পরিচালনার ক্ষমতাসম্পন্ন।
সাধারণত সরকার শব্দটির দ্বারা একটি সাধারণ সরকার বা সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বোঝায়। অন্যদিকে একজন ব্যক্তি বলতে বোঝায় একজন মানুষ। বিশেষ করে নিজস্ব অনুভূতি, বোধ, বুদ্ধি, মননসম্পন্ন একটি ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সেই একজন ব্যক্তিই নাকি বাংলাদেশের পক্ষে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ করে রেখেছেন! এই একজন মাত্র ব্যক্তিই নাকি দেশের একমাত্র সমস্যা। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার চালানোর জন্য মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিযুক্ত করে নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশির সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অর্থমন্ত্রী। দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, দুর্ভাগ্যজনকও বটে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেওয়া হলো নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য আইন সংশোধনের পর থেকে এই নোবেলজয়ীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। তবে এর শেষ কোথায়, আমরা জানি না। ড. ইউনূসের বিপক্ষে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটা বিরুদ্ধ বলয় সৃষ্টি হয়, যখন তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সময় নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় রাজনীতিকে বিরাজনৈতিকীকরণের একটা হীনচেষ্টা প্রবল হয়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য ড. ইউনূস রণে ভঙ্গ দিয়ে সরে আসেন। হয়তো বর্তমান সরকার ভাবছে, ইউনূস আবার নতুন করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। কারণ নতুন প্রজন্মের কাছে ড. ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা থাকার পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন।
কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাংকটিতে কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনা বা বজায় রাখার জন্য গোটা বিশ্বে একটি প্রবল শক্তিশালী পক্ষ এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এই বলয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং ইকোনমিস্ট, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো শক্তিশালী মিডিয়া। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভেতরেও আছে পশ্চিমা অর্থে গড়ে ওঠা বড় বড় এনজিও। তাই ইউনূসের ভালো একটা ক্ষমতা যে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই ইউনূসের বিপক্ষে অনর্থক ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, হীনম্মন্যতা আর পরশ্রীকাতরতার অবস্থান নিয়েছে সরকার। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকার যদি মাত্র একজন শান্তিতে নোবেলজয়ীর কাছে নিজেদের শক্তিহীন বলে ফলাও করে প্রলাপ করে বেড়ায়, তাহলে সেই সরকারের গদি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাই এ বিষয়ে মন্ত্রীদের আরো বেশি সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। অন্যের ওপর দোষ চাপানোর আগে ভাবতে হবে, এর ফলে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা নিজেরাই আবার হারিয়ে না ফেলেন।
এ কথা সত্য, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার যে উন্নতি হয়েছে, তা অনেকটা এনজিওগুলোর হাত দিয়েই এসেছে। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে চমকপ্রদ অগ্রগতির জন্য রাজনীতিকদের ভূমিকা সব সময় বেশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। রাজনীতিকরা যদি দেশটা নিয়ে কামড়াকামড়ি না করতেন, ছিঁড়ে-খুঁড়ে না খেতেন, তাহলে ৪০ বছরে এ দেশ হয়তো অন্য রকম হতো।
সরকার হয়তো ভুলেই বসেছে যে ড. ইউনূস ছাড়াও আমাদের দেশে অসংখ্য সমস্যা রয়েছে। এ দেশের কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও ধানের দাম পায় না। শেয়ার কেলেঙ্কারির জন্য দায়ীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য দায়ীরা এখনো পর্দার অন্তরালে। রেলের কালো বিড়াল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই দুর্নীতি ফাঁস করে দেওয়া ড্রাইভার ঠিকই ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে জীবনের নিরাপত্তা চাইছে। পদ্মা সেতুর ভবিষ্যৎ এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন।
এসব সমস্যা সমাধানের চেয়ে সরকার ব্যস্ত অন্য কাজে। বছরখানেক সময় সামনে রেখে সরকারের এখন উচিত দেয়ালের লিখন পড়া, বাতাসে ভেসে আসা কথা কান পেতে শোনা, জনগণের চোখের ভাষা জানা, মনের কথা বোঝার চেষ্টা করা এবং সেই মতো কাজ করা। ২০০৮-এর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির দিকে ফিরে তাকানো, বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, প্রতিশ্রুতির কতটুকু সরকার পূরণ করতে পেরেছে আর কতটুকু বাকি রয়েছে, কিভাবে এই অল্প সময়ের মধ্যে জনগণকে দেওয়া ওয়াদা সম্পূর্ণ করা যায়, কেমন করে মানুষের মন জয় করে তাদের আস্থা দল ও জোটের ওপর আবার ফিরিয়ে আনা যায়- এ মুহূর্তে এসবই হওয়া উচিত সরকারের মূল চিন্তার বিষয়বস্তু। কিন্তু সরকারের এদিকে নজর আছে বলে মনে হয় না। সরকারের মন্ত্রীরা একের পর এক বক্তব্য দিয়ে নিজেদের বিতর্কিত করে তুলছেন। এ ছাড়া ইউনূস ইস্যু যেন তাঁরা হাতছাড়া করতেই চাচ্ছেন না, যদিও এটিকে অনেকটা পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করার মতোই মনে হচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে জটিলতার শুরু হয়েছিল বয়সের কারণে ড. ইউনূসকে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরকার কর্তৃক অপসারণের মাধ্যমে। তারপর ওই পরিস্থিতির শেষ হয়েছিল আদালতের ঘাড়ে বন্দুক ব্যবহারের মাধ্যমে। ড. ইউনূস হেরে যান এবং যথারীতি সরকার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হাতবদল করে। কিন্তু এই ব্যাপক কার্যকারণের মধ্যে সরকারের একটি কঠিন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা গেছে। ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সরকারের ওপর পরোক্ষভাবে চাপও সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে এবং বাংলাদেশে সফরের সময় ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এবং গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংস না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন বারবার। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট ২০১২ তারিখে একটি পত্রের মাধ্যমে তিনি আরেকবার অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিশেষভাবে সজাগ আছে। তাই মাঝেমধ্যেই তাদের এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় ইউনূসকে প্রকাশ্যে তুলোধুনো করছেন। কখনো কখনো তাঁরা পদ্মা সেতু না হওয়ার জন্য ইউনূসকে দায়ী করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে ও সংসদের বাইরে একাধিকবার পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের কারণ হিসেবে ইউনূসকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। সরকারের অহেতুক আচরণে প্রমাণিত হয়, সরকারের চেয়ে বর্তমানে এ দেশে ইউনূসই বড় ক্ষমতাধর।
আসলে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিশ্বব্যাপী ড. ইউনূস আর মাইক্রোক্রেডিটের প্রশংসা শুনতে শুনতে কানে ঘা হয়ে গেছে বলে মনে হয়। নতুবা ড. ইউনূস দেশবিরোধী কাজে জড়িয়েছেন কিংবা তিনি দেশের একমাত্র সমস্যা ইত্যাদি দায়িত্বহীন কথাবার্তা কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়া দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কী করে বলেন তা বোধগম্য নয়। অথচ ড. ইউনূসের সঙ্গে বিরোধের পর গত কয়েক বছরে সরকার বিদেশি সহায়তা ব্যাপকভাবে পেয়েছে। সহজ শর্তে বিদেশি ঋণ বা অনুদান পেতে কোথাও সমস্যা হয়নি সরকারের। কিন্তু ব্যাপক অর্থ কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য যখন অভিযোগের আঙুল সরকারের দিকে যাচ্ছে এবং বিনিয়োগ, অবকাঠামো, জ্বালানি খাতে দুর্নীতি চরমে পৌঁছেছে, ঠিক তখনই সরকারের সব ব্যর্থতাকে আড়াল দিতে একজন ব্যক্তির ঘাড়ে সব দোষ চাপানোর হীনচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ড. ইউনূসকে সমস্যা না ভেবে দেশের অসংখ্য সমস্যা দূরীকরণে সরকার বেশি মনোনিবেশ করলে রাষ্ট্র, জনগণ, সর্বোপরি সরকার লাভবান হবে বলে মানুষের বিশ্বাস।
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.comআ

No comments

Powered by Blogger.