কালিয়াকৈরে জাল দলিল নিয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন- ৫০০ একর জমির দলিল জাল, ২৩ জন চিহ্নিত by রোজিনা ইসলাম

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ৫০০ একর জমি জাল দলিলের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে সরকারি তদন্ত কমিটি। কমিটি এ জন্য দলিল গ্রহীতা টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমান এবং স্থানীয় ভূমি ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা, দালালসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াহিদুর রহমান (ফিরোজ রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) কালিয়াকৈর থানা এলাকার একটি আবাসন প্রকল্প করার জন্য জমি কিনতে টিপু সুলতানের সঙ্গে চুক্তি করেন। টিপু সুলতান এলাকায় কিছু ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করেন। এঁদের অন্যতম পশ্চিম খোলাপাড়ার ইয়াসিন সাহবাজপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা (সহকারী তহশিলদার) কাওছার মোল্লার সঙ্গে যোগসাজশে ওই এলাকার বিভিন্ন জমি ভুয়া জমা খারিজ করে এবং ভুয়া খাজনা রসিদ তৈরি করে মানুষের জমি জাল আমমোক্তারনামা দলিল করেন।
প্রসঙ্গত, গত ৮ নভেম্বর প্রথম আলোতে ‘কালিয়াকৈরে ৫০০ বিঘা জমির জাল দলিল’ শিরোনামে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তারপর সরকার আইন ও বিচার বিভাগের উপসচিব অরূপ কুমার গোস্বামীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে সহায়তা করেছেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব জহিরুল হক।
কমিটি সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জমা দিয়েছে।
যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: প্রতিবেদনে যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তাঁরা হলেন: জাল দলিলকারী ওবায়দুর রহমান, টিপু সুলতান, কালিয়াকৈর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শফিয়র রহমান, কালিয়াকৈর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান, উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা কাওছার হোসেন মোল্লা, দলিল লেখক তমছের, আবদুল কুদ্দুস ও জমির দালাল ইয়াছিন আলী।
তা ছাড়া এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত স্থানীয় রবিউল করিম, আবদুর রহমান, মো. লিয়াকত, মো. দুলাল, হানিফ আলী, আবদুর রশীদ, মেছের আলী, ইয়াদালী, জামাল, ওয়াহিদ ইকবাল, ছোহরাব হোসেন, ফরমান আলী, মো. আমিনুর, আশরাফ হোসেন, মো. শাহীনুর, আইয়ুব মণ্ডল ও আবদুর রহমান মাস্টারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
কেন অভিযুক্ত: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কালিয়াকৈর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমানের অসতর্কতা ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে এসব দলিল জাল করা সম্ভব হয়েছে। তিনি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো। কর্তব্যে চরম অবহেলার কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর ২(এফ) বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ তাঁর বিরুদ্ধে অন্য যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
দলিল লেখক তমছের ও আবদুল কুদ্দুস জাল দলিল করার সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁদের দলিল লেখার সনদ বা লাইসেন্স বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত কালিয়াকৈরের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা কাওছার হোসেন মোল্লাকে ইতিমধ্যে বদলি করা হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটির মতে, এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অনেক বেশি গুরুতর ও সুপ্রমাণিত। তাই বদলিই তাঁর গ্রহণযোগ্য শাস্তি হতে পারে না।
অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ এবং সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভুয়া খাজনা রসিদ এবং ভুয়া নামজারি ও জমা ভাগ তৈরি করায় তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে।
নামজারি ও জমা ভাগ বিষয়ে সরকারি কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু কালিয়াকৈর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শফিয়র রহমান দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় তাঁকে অন্য স্থানে বদলির পর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
এই জালিয়াতির মূল ব্যক্তি ইয়াছিন আলী। প্রতিবেদনে এ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে বলা হয়, ইয়াছিন আলীর নির্দিষ্ট বা দৃশ্যমান উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকলেও তিনি অনেক টাকার মালিক। ইয়াসিন আলী এলাকায় পাঁচতলা বাড়ি করেছেন এবং ওই বাড়ির ফিটিংস বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন। কমিটি তাঁর সম্পদের উৎসের বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানোর সুপারিশ করেছে।
সুপারিশ: কমিটির মতে, আমমোক্তারনামা দলিলের ক্ষেত্রে ১৮৮২ সালের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইনে সম্পত্তির মালিকানাসংক্রান্ত দলিল দাখিলের আবশ্যকতা না থাকায় এসব জাল দলিল হচ্ছে।
এ কারণে সম্পত্তির উন্নয়ন ও হস্তান্তরের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌর এলাকার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র সম্পত্তির স্বত্বসম্পর্কিত ২৫ বছরের ইতিহাস ও বিবরণ এবং এর সমর্থনে কাগজ পর্যালোচনা করে দলিল নিবন্ধনের জন্য নির্দেশ দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসকে পরিপত্র ইস্যু করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া স্থাবর সম্পত্তিসংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন আমমোক্তারনামার ক্ষেত্রে দলিলের তফসিলে লিখিত ভূমির বাজারমূল্য অনুসারে স্ট্যাম্প ফি দেওয়ার জন্য স্ট্যাম্প আইনের সংশ্লিষ্ট তফসিল সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির পর্যালোচনা: তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কালিয়াকৈর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে আমমোক্তারনামা দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করা হয়েছে, যার দাতা ওই সম্পত্তির মালিক নন। এর মধ্যে ১৩৪৯৩/১২ দলিলে দাতা হিসেবে বহর আলী দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দিলেও ওই বহর আলী ৫০ বছর আগে মারা গেছেন। এই দলিলের দাতা বহর আলীর স্থানে মেছের আলীর ছবি লাগিয়ে দলিল করা হয়েছে। ১২৯৮৭/১২ নং দলিলের দাতা মোগর আলী ১৯৯৮ সালের ১৪ জুন মারা গেছেন মর্মে মৃত্যুসনদের ফটোকপি দাখিল করা হয়েছে।
৫১২/১২ দলিলের দাতা দেওয়ান আওলাদ হোসেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের ২ জুন মারা যান।
ইয়াদালী ট্রাকচালকের সহকারী। ইয়াদালী ১২১৮৮/১২ নং দলিলের দাতা সেজে টিপু সুলতানের কাছে ৯৮০ শতাংশ সম্পত্তি হস্তান্তর করলেও তাঁর কোনো সম্পত্তি নেই।
বছির উদ্দিন ১০২৪৭/১২ ও ৬০১৫/১২ নং দলিলে ৫১৭ শতাংশ সম্পত্তি হস্তান্তর করলেও তিনি একজন ভূমিহীন এবং অন্যের জমিতে বসবাস করেন।
৫১৩/১২ নং দলিলের দাতা হিসেবে আবদুস সামাদের ছবি সংযুক্ত না করে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।
৫১০/১২ ও ৫১১/১২ দলিলের দাতা মো. রবিউল করিম কোনো সম্পত্তির মালিক না হওয়া সত্ত্বেও ওই দলিলমূলে সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন।
জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি তদন্তের দিন জাল দলিলের যে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে, সে হিসেবে জাল দলিলের সংখ্যা উল্লেখ করেছে। আমাদের হিসাবে প্রায় ১৬০০ একরের বেশি জমির জাল দলিল করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.