আযাদের বিরুদ্ধে মামলা বোনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিলেন এক সাক্ষী

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল মঙ্গলবার সাক্ষ্য দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের দুই সাক্ষী। জবানবন্দিতে তাঁদের একজন বলেন, একাত্তরে আযাদ তাঁর বোনকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখেন।
পরে তাঁর বোন আত্মহত্যা করেন। অপর সাক্ষী ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ গতকাল সাক্ষ্য দেন রাষ্ট্রপক্ষের একাদশ সাক্ষী দেব কুমার দাস ও দ্বাদশ সাক্ষী রওশন আলী বিশ্বাস। তাঁরা ফরিদপুরের সালথা উপজেলার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও প্রতিবেশী।
জবানবন্দিতে দেব কুমার বলেন, একাত্তরের ১৮ মে বেলা তিনটার দিকে বাচ্চু রাজাকারের (আবুল কালাম আযাদ) সঙ্গে অস্ত্রধারী সাত-আটজন তাঁদের বাড়িতে যায়। বাচ্চু তাঁর ছোট বোন অঞ্জলী দাসকে (১৮) বিয়ের প্রস্তাব দিলে তাঁর বাবা গুরুপদ দাস (বর্তমানে মৃত) তা নাকচ করেন। তখন বাচ্চু ও তাঁর সঙ্গীরা অঞ্জলীকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। তাঁর (সাক্ষী) বাবা গ্রামের দু-একজন মাতব্বরের কাছে গিয়ে মেয়েকে ছাড়ানোর অনুরোধ করেন। বাচ্চুর শ্বশুর চাঁন কাজীর মাধ্যমে অনুরোধ করা হলে সাত-আট দিন পরে অঞ্জলীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই সাক্ষী আরও বলেন, একদিন সকালে তিনি অসুস্থ অবস্থায় বোনকে বাড়ি ফিরতে দেখেন। ওই দিনই বেলা আড়াইটার দিকে বাচ্চুর সঙ্গীরা অঞ্জলীকে আবার নিয়ে যেতে তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায়। এটা জানতে পেরে অঞ্জলী বিষপানে আত্মহত্যা করেন। এ সময় তাঁদের বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হলে বাচ্চুর সঙ্গীরা চলে যায়। সন্ধ্যার দিকে বাচ্চু তাঁদের বাড়ি গিয়ে মরদেহ মাটিচাপা দিতে বলেন। কিন্তু তাঁর বাবা এতে রাজি হননি। অঞ্জলীর মরদেহ হিন্দু ধর্মমতে সৎকার করা হয়। এর ৯-১০ দিন পর বাচ্চুর লোকজন আবার তাঁদের বাড়িতে গিয়ে লুট করে এবং ঘরের টিন খুলে নিয়ে যায়।
দেব কুমারের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান। পরে তাঁকে জেরা করেন আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান। আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি বাচ্চুকে চেনেন। তবে ভালো নাম জানতেন না।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের দ্বাদশ সাক্ষী রওশন আলী বিশ্বাস (৬০) জবানবন্দি দেন। তিনিও অঞ্জলীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলেন। তিনি বলেন, একাত্তরের ১৮ মে প্রতিবেশী দেব কুমারের বাড়িতে কান্নাকাটি শুনে তিনি দৌড়ে গিয়ে দেখেন, বাচ্চু রাজাকার ও তাঁর সঙ্গে থাকা সশস্ত্র লোকজন অঞ্জলীকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ছয়-সাত দিন পর অঞ্জলী বাড়ি ফিরলে তিনি তাঁকে দেখতে যান। ওই দিনই বেলা দুই-তিনটার দিকে মোহাম্মদ কাজী (আযাদের শ্যালক) কয়েকজনকে নিয়ে অঞ্জলীকে নিতে যায়। বিষয়টি টের পেয়ে অঞ্জলী বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
অঞ্জলীর মরদেহ সৎকার এবং দেব কুমারের বাড়ি লুটের বিষয়েও একই বিবরণ দেন রওশন। তিনি বলেন, বাচ্চু পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করতেন। তিনি অনেক লোককে হত্যা ও নির্যাতন করেছেন, অনেক নারীর সম্ভ্রমহানি করেছেন।
এ সময় কাঁদতে কাঁদতে রওশন বলেন, ‘এই বাচ্চু রাজাকার আমার বাড়ি ভেঙেছে, আমরা জঙ্গলে পালিয়ে বেড়িয়েছি। পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও তাঁর ভয়ে গ্রামের প্রায় সব হিন্দুই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমি ভারতে পালাতে গিয়ে মাগুরায় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিত হয়েছি।’
জবানবন্দি শেষে রওশনকে জেরা করেন আবদুস শুকুর খান। আজ বুধবার এই মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের ব্যাখ্যা চেয়েছেন ট্রাইব্যুনাল: গতকাল একই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু তাঁদের কোনো আইনজীবী হাজির ছিলেন না। ট্রাইব্যুনালকে অবহিত না করে তাঁদের এই অনুপস্থিতি সঠিক নয় উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলেন, আইনজীবীদের অনুপস্থিতি কেন অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হবে না—তার ব্যাখ্যা ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে দিতে হবে।
এই আইনজীবীরা হলেন: তাজুল ইসলাম, আবদুস সোবহান তরফদার, কফিল উদ্দিন চৌধুরী ও এহসান সিদ্দিকী।

No comments

Powered by Blogger.