আইন-অপরাধী হওয়ার মতো বয়স কি হয়েছে? by জাহাঙ্গীর আলম সরকার

শিশু আইন অনুযায়ী কিশোরদের কারাদণ্ডের বদলে নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া দরকার। কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থা প্রয়োগ করা শিশু অধিকার সনদের সুনির্দিষ্ট আহ্বান ছাড়া সম্ভব নয়।
এর প্রথম এবং আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে, অভিযুক্ত কিশোরকে তার স্বীয় অপরাধ স্বীকার করে নিতে হবে
আমাদের দেশের কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক বেড়ে যাওয়ায় কিশোর অপরাধ একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় কিশোর অপরাধের অন্ধকার অধ্যায়, সংশোধনের জন্য অপরাধী কিশোরদের আটক রাখা, তাদের বিচার ব্যবস্থা, দেশের প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তজার্তিক মান নিশ্চিত হচ্ছে কি-না? আদালতে বিচার না করে বিকল্পের সন্ধান করা যায় কি-না? এবং বিকল্প হিসেবে বিচার-পূর্ব মীমাংসা করা যায় কি-না? এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা গত দুই দশকের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি হয়েছে। এ কিশোর অপরাধীদের অপরাধী হওয়ার মতো বয়স কি হয়েছে? ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়াটা ওদের অনিচ্ছাকৃত। ছিন্নমূল, টোকাই, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান_ যাদের কাছে সমাজ মানেই শোষণ ও বঞ্চনার হাতিয়ার তারা সমাজের প্রতি, বিশেষত সমাজের প্রতিষ্ঠিত নীতি-নিয়মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তারা এমন এক মানসিক অবস্থার শিকার_ যে অবস্থায় সবকিছু ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। এ কথাও সত্য_ ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত গ্রেফতারকৃতদের একটি অংশ সমাজের বিত্তবান ও উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীদের সন্তান। এ অবস্থায় গোটা বিষয়টি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে একটা সত্য স্পষ্ট দেখা যায়। তাহলো, কিশোরদের অপরাধপ্রবণতার পেছনে রয়েছে সামাজিক ও পারিবারিক পরিস্থিতি।
একটি মৌলিক প্রশ্ন প্রত্যেকের মধ্যে উচ্চারিত হতে পারে_ কেন এসব কিশোর এভাবে অপরাধের প্রতি ঝুঁকছে?
বাংলাদেশে আইনের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত শিশুদের প্রসঙ্গটি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। কিশোরদের কল্যাণ, উপযুক্ত আচরণ পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান এবং নিজেকে শোধরানো ও উন্নতি ঘটানোর সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ আইনের অধীন কিছু মৌলিক নিয়মবিধি আছে যা শিশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যথা_ এক. গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটির বয়স সম্পর্কে অবহিত হতে হবে; দুই. গ্রেফতার করা শিশুকে বড়দের কাছ থেকে আলাদা তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে; তিন. শিশুদের কিশোর আদালতের মাধ্যমে বিচার করতে হবে এবং চার. কোনো শিশুর জন্য যদি স্বাধীনতা রহিত করা প্রয়োজন হয় তাহলে তার বৃহত্তর স্বার্থে তাকে সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিশু আইন ১৯৭৪ অগ্রাহ্য করে এবং তার অধীন গ্রেফতারের শর্তগুলো অনুসরণ ছাড়াই শিশুদের গ্রেফতার ও আটক করা হচ্ছে। যেসব আইনের অপব্যবহার করে শিশুদের আটক করা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা, মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের ৮৬ ধারা এবং ভবঘুরে আইন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা শিশুদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। এ আইন অনুযায়ী পুলিশ যে কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধরনের পরোয়ানা ছাড়াই শুধু সন্দেহবশত গ্রেফতার ও আটক করার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের বিধান মতে, আটক ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিধান মানা হয় না।
আমাদের দেশে কিশোরদের বিচার প্রক্রিয়ায় বহু আইনি জটিলতা লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ সময় যে ধরনের আইনের অপব্যবহার দেখা যায় তা নিম্নরূপ।
যথা_ এক. আদালত না বসার কারণে শিশুরা বেশি সময় পুলিশ হেফাজতে থাকে; দুই. যদি তাদের পরিবার থেকে জামিন না নেওয়া হয় তাহলে তারা বছরের পর বছর জেলে থাকে; তিন. বেশিরভাগ সময়ই নিরাপদ হেফাজত জনবহুল হয়ে থাকে; চার. কর্মচারী থাকে অপ্রতুল; পাঁচ প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা জেলখানায় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়; ছয়. অপর্যাপ্ত খাবার; সাত. নোংরা পোশাক; আট. পরিষ্কার শৌচাগারের অভাব; নয়. শিশুদের ঘুমানোর স্থানের অভাব; দশ. শিক্ষা সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয় এবং এগারো. খুব সামান্য অপরাধের জন্য দীর্ঘদিন আটক রাখা হয়।
১৯৭৪ সালের শিশু আইনে কিশোরদের জন্য পুলিশি হেফাজতমূলক শাস্তি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষত তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের জায়গায় পাঠানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেদনাদায়ক হলেও সত্য, আইনের সেসব বিধান কাগুজেই হয়ে রয়েছে। ১৬ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর বিচারের ক্ষেত্রে আদালতকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে_
এক. শিশুর চরিত্র ও বয়স; দুই. শিশুর জীবনযাপন প্রেক্ষাপট; তিন. অবেক্ষণ কর্মকর্তার তথ্য প্রতিবেদন এবং চার. শিশুটির স্বার্থে আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী এ রকম অন্য যেসব ব্যাপার বিবেচনায় আনা উচিত।
শিশুকে কারাদণ্ড প্রদান বা আটক রাখার শাস্তিদানের আগে উপরোক্ত বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। শিশু আইনের ৫১ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, 'অন্য কোনো আইনে এর সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ যাই থাকুক না কেন, তৎসত্ত্বেও কোনো শিশুকে মৃত্যুদণ্ড, দ্বীপান্তর অথবা কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না।' অতঃপর আইনটি শিশুদের স্বাধীনতা হরণের দুটি স্বতন্ত্র ভিত্তির উল্লেখ করেছে। এগুলো হচ্ছে এক. 'যদি আদালত দেখেন যে, শিশুটি এমন কোনো অপরাধ করেছে যে আইনে এর জন্য যে শাস্তির বিধান আছে তা পর্যাপ্ত নয় এবং দুই আদালত যদি এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, শিশুটি এতটাই নির্মম ও কলুষিত চরিত্রের যে, তার জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এবং অন্য উপায়গুলো উপযুক্ত নয়।' আইনের ৫২ ধারা মতে, যে শিশুরা মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে তাদের আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন।
সব বিবেকবান মানুষের মধ্যে একটি মৌলিক প্রশ্ন উচ্চারিত হতে শুরু করেছে। তাহলো, অপরাধী হওয়ার মতো বয়স কি হয়েছে ওদের? শিশু আইন অনুযায়ী কিশোরদের কারাদণ্ডের বদলে নিজেকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া দরকার। কিশোর অপরাধীদের ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থা প্রয়োগ করা শিশু অধিকার সনদের সুনির্দিষ্ট আহ্বান ছাড়া সম্ভব নয়। এর প্রথম এবং আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে, অভিযুক্ত কিশোরকে তার স্বীয় অপরাধ স্বীকার করে নিতে হবে। যদি সে অপরাধ স্বীকার করতে অস্বীকার করে তাহলে একমাত্র পথ হচ্ছে আনুষ্ঠানিক বিচার। ভুলে গেলে চলবে না, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। এর ওপর নির্ভর করবে বিকল্প বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।

জাহাঙ্গীর আলম সরকার: আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.