শেষ দিনে রোমাঞ্চের আবাহন by উৎপল শুভ্র

টেস্ট ম্যাচ হলো পেঁয়াজের মতো। একটি পরত ছাড়ালে দেখা দেয় আরেকটি পরত। আকারে আলাদা, কখনো কখনো রঙেও। ঝাঁজেও বোধহয় তারতম্য হয়! ঢাকা টেস্টের প্রথম তিন দিন রঙে-ঝাঁজে প্রায় একই রকম। বলের ওপর ব্যাটের একচ্ছত্র আধিপত্যের গান।


রংটা বদলাল কাল চতুর্থ দিনের শেষ এক ঘণ্টায়। এমনই যে, হঠাৎই নাকে এসে লাগতে শুরু করল টেস্ট ম্যাচের ঝাঁজ। ড্র-ই ছিল যে টেস্টের সবচেয়ে সম্ভাব্য ফল, চতুর্থ দিনের খেলা শেষ হতে হতে দেখা যাচ্ছে, চারটি ফলই এতে সম্ভব। চারটি ফলই! বাংলাদেশের জয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় ও ড্রয়ের পাশে ‘টাই’টাকেও রাখবেন না কেন! আজ শেষ দিনের খেলা শুরু হচ্ছে তাই রোমাঞ্চের আবাহনে।
চতুর্থ দিনের ১৩ ওভারের মতো বাকি থাকতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ উইকেটে ২০৯। শুরুতেই গেইলকে হারানোর পর পাওয়েল-ব্রাভো জুটি ডাবল সেঞ্চুরির রূপ নেওয়ার অপেক্ষায়। এই ম্যাচের ভবিষ্যৎ গতিপথ তো পুরোপুরিই ড্যারেন স্যামির হাতে। শেষ দিনে কখন যে ছাড়বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ! নিশ্চয়ই সম্ভাব্য ফলের তালিকা থেকে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাজয়’টা মুছে দিয়ে। সেটি কখন—পঞ্চম দিন লাঞ্চের সময়? কত ওভার টিকতে হবে বাংলাদেশকে?
দিনের শেষ ১৩.১ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ব্যাপারটা আর স্যামির ইচ্ছানির্ভর রাখলেন না বাংলাদেশের বোলাররা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২১৫ রানে এগিয়ে, হাতে উইকেট ৪টি। যেটি আসলে ‘তিন’ও হতে পারে! ডাবল সেঞ্চুরি করার পর থেকেই শিবনারায়ণ চন্দরপল মাঠে নেই। পরশু ফিল্ডিং করেননি, কাল ব্যাটিংয়েও নামলেন না। কারণটা রহস্যে মোড়া। দিনশেষের সংবাদ সম্মেলনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডিয়া ম্যানেজার ‘চন্দরপল ইজ ইল’-এর বেশি বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে রহস্যটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন। শেষ দিনে ব্যাটিং করতে পারবেন কি না, এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।
বাংলাদেশের বোলাররা প্রথম ইনিংসের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিলেন কাল বিকেলে। তবে কাইরান পাওয়েল জ্বললেন আরও উজ্জ্বল হয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি সব ব্যাটসম্যানের পাশে লিখে ফেললেন নিজের নাম। জুনায়েদ সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হলে কি কৃতজ্ঞতা জানাবেন! শাহাদাতের বলে ১৭ রানে স্লিপে সহজ ক্যাচ ফেলে না দিলে তো আর এই কীর্তি গড়া হয় না।
প্রথম ইনিংসে দু দলই পাঁচ শতাধিক রান করে ফেললে সেই টেস্টের ভাগ্যে ড্র একরকম লেখাই হয়ে যায়। পাঁচ শ করার পর কেউ আর হারে নাকি! কী আশ্চর্য, টেস্ট ইতিহাসে ১৩ বার পাঁচ শ করেও পরাজয়ের বেদনায় পোড়ার ঘটনা আছে।
সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণটি চার বছর আগে। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৫৩২ করেও হারতে হয়েছিল ভারতকে।
এই ম্যাচেও বাংলাদেশ বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘ভারত’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই। শেষ ঘণ্টায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের একের পর এক উইকেট পতন আনন্দের পাশে দুশ্চিন্তাও যে উপহার দিয়ে গেল। মারলন স্যামুয়েলস সোহাগের যে বলটিতে আউট হলেন, সেটি দেখে সুনীল নারাইন বা ভিরাসামি পেরমলেরও কম খুশি হওয়ার কথা নয়। হঠাৎই লাফিয়ে উঠল বলটা। শেষ দিনের ক্ষতবিক্ষত উইকেটে বল এমন আরও নিজের মর্জিমাফিক কাণ্ডকীর্তি করবে। শেষ পর্যন্ত তাই কী হবে, কিছুই বলা যায় না!
বাংলাদেশ দলের মুখপাত্র হয়ে এ কথাটাই বলে গেলেন নাসির হোসেন। সেটি বললেন নিজস্ব ভঙ্গিতে, ‘গোল বলের খেলা—কী হবে কিছুই বলা যায় না।’ ক্রিকেটের গৌরবময় অনিশ্চয়তা নিয়ে কত রকম কথাই না হয়েছে। তবে সেই অনিশ্চয়তার মূল কারণ যে ‘বলটা গোল’, এটা কি নাসিরই প্রথম উদ্ঘাটন করলেন!
এই নাসিরের কারণেই কালকের দিনটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা হয়ে রইল। ৭৫ বলে ৩৩ নিয়ে দিন শুরু করেছিলেন। কাল ৬৩ করলেন ৬১ বলে। মাহমুদ্উল্লাহর সঙ্গে ১২১ রানের জুটিতেই টেস্টে আগের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড অতীত হয়ে গিয়েছিল। প্রথমবারের মতো পাঁচ শর দেখা মিলল শাহাদাতের সঙ্গে নবম উইকেটে তাঁর ৬১ রানের জুটিতে। দলীয় অর্জনের আনন্দের পাশে অবশ্য শুয়ে রইল নাসিরের ব্যক্তিগত দুঃখ। মাত্র ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরিটা হলো না।
বাংলাদেশের ইনিংস শেষে স্কোরবোর্ডে যখন ৫৫৬ দেখাচ্ছে, কেমন যেন অতিপ্রাকৃত লাগছিল অঙ্কটাকে। এগারো মাস পর টেস্ট খেলতে নামা বাংলাদেশ কীভাবে করে ফেলল এই কাণ্ড! নাঈমের সেঞ্চুরি আর চার ফিফটিতে ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা মেলে। তার পরও কবিতার ওই লাইনটা কেন যেন ঘুরে বেড়ায় মনে—কত কিছু দৈবে ঘটে ধরণীর পদপ্রান্তে এসে!
আজও আরেকবার ঘটুক না!
চতুর্থ দিনের শেষে: ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৫২৭/৪ ডি. ও ২৪৪/৬; বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৫৫৬

No comments

Powered by Blogger.