ভাসানী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম প্রধান পুরোধা by গাজীউল হাসান খান

একজন অতি সাধারণ গ্রামীণ মানুষ হয়েও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মওলানা ভাসানী ছিলেন ব্যাপক গণমানুষের অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যতম প্রধান পুরোধা।


এ উপমহাদেশের সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি এক আপসহীন রাজনীতির ধারক ও বাহক ছিলেন। একজন ধার্মিক মানুষ হয়েও তিনি আপাদমস্তক ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এ নেতা এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হলেও তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছিলেন এ দেশের অনেক প্রগতিশীল তথা বাম ধারার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। ভারত বিভক্তির পর, অর্থাৎ পাকিস্তান অর্জনের পরও জনগণের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তাঁকে বিভিন্ন সময় কারাবরণ করতে হয়েছে। ভাসানী ভোগের নয়, ত্যাগের আদর্শে বিশ্বাস করতেন। হয়তো বা সে কারণেই শহর-নগরের বিলাস ব্যসন ও অধিকাংশ রাজনীতিকের যাপিত অস্বচ্ছ ও জটিল জীবনধারা পরিহার করে তিনি গ্রামীণ পরিবেশে সহজ-সরল জীবনযাপনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর চলা-বলা ও পোশাকে গ্রামবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের প্রতিফলন ঘটেছিল, তাতে তিনি নিজেকে এতটুকু খাটো কিংবা অপাঙ্ক্তেয় মনে করতেন না।
মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তি ও অধিকার আদায়ে গণ-অভ্যুত্থান, এমনকি সশস্ত্র বিপ্লবকে নীতিগতভাবে একটি অন্যতম হাতিয়ার মনে করলেও তিনি নিজে ছিলেন একটি সংসদীয় রাজনৈতিক দলের প্রধান। অবশ্য নির্বাচন দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায় ও শোষণমুক্তি ঘটবে বলে তিনি মনে করতেন না। সে কারণে কেউ কেউ তাঁকে 'লাল মওলানা' বলেও অভিহিত করেছেন তাঁর বিভিন্ন কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের 'কাগমারী সম্মেলনে' পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবে বিদায় জানানোর কথা বলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা বা স্বাধীনতার স্পৃহা উস্কে দিয়েছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। অখণ্ড ভারতে কংগ্রেস ছেড়ে শেষ পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগে যোগ দিলেও পাকিস্তান অর্জনের পর পরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও স্বরূপ দেখে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। মুসলিম লীগের বিপক্ষে পাকিস্তানে অতি দ্রুত একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে তোলার জন্য ভাসানী অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ইসলামের নাম ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক-শ্রমিকসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতি জনতাকে শোষণ-শাসন ও প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, অখণ্ড পাকিস্তানে পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উন্নত বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন মওলানা ভাসানী। পূর্ব বাংলার অত্যন্ত সাধারণ পরিবার থেকে আসা এবং ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত আবদুল হামিদ খানের রাজনীতির সূত্রপাত হয়েছিল গ্রামীণ মানুষ ও মূলত কৃষক সমাজের অভাব-অনটন ও শোষণ-বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে। কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার জমিদার-মহাজনি শোষণ ও সামন্তবাদী প্রথার বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল যৌবনের সূচনা থেকেই।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আবদুল হামিদ খানের জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালে। বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের ধানগড়া ছিল তাঁদের আদি নিবাস। নিজ অঞ্চলের মক্তবে শিক্ষার সূচনা হলেও ইসলামিক উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি শায়খুল হিন্দ নামে খ্যাতনামা প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদ মাহমুদুল হাসানের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরই কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল তরুণ আবদুল হামিদ খানের। এর অনেক পরে আসামের ভাসানচরে দরিদ্র বাঙালি কৃষককুলের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি ভাসানী নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তখন সংগ্রামী কৃষককুলের মধ্যে অনেকে তাঁর আসল নামটি ভুলেই গিয়েছিল। তাঁর নামে আসামের ধুবড়ি এলাকায় একটি বিশাল চরাঞ্চলের নাম হয়েছিল হামিদাবাদ আর তিনি মওলানা ভাসানী হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন তাঁর সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলনের কারণে। এর আগে, অর্থাৎ ১৯১৭ সালে, তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বাধীন স্বরাজ পার্টি বা একটি জাতীয়তাবাদী দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে যোগ দেন। তারপর ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী প্রখ্যাত নেতা মোহাম্মদ আলীর উৎসাহে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। সেটি ছিল ১৯১৯ সাল। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন তখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল। সে আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ও নেতৃস্থানীয় ভূমিকার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা বা সংগ্রামী কার্যকলাপ থেমে থাকেনি। কারাগার থেকে মুক্ত হয়েও তিনি আবার দেশবন্ধুর নেতৃত্বে সূচিত ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং আবার গ্রেপ্তার হন। সে সময় তিনি ভারতে সূচিত খেলাফত আন্দোলনেও তাঁর অবদান রেখেছিলেন। তা ছাড়া কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মসূচি ও বিতর্কিত ভূমিকার জন্য সে সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান যথেষ্ট প্রতিবাদী ও সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। এভাবে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একপর্যায়ে ১৯৩০ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। পরে ১৯৩৭ সালে তিনি উত্তর ধুবড়ি নির্বাচনী এলাকা থেকে আসামের আইনসভায় এমএলএ নির্বাচিত হন, যা ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল বলে জানা যায়। তিরিশের দশক থেকে ভাসানী পূর্ব বাংলা এবং বিশেষ করে আসামের বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আসামের দরিদ্র ও শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি কৃষককুলের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের জন্য ভাসানী আইনসভার ভেতরে ও বাইরে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। এরই মধ্যে, ১৯৪৪ সালে তিনি আসামসহ সে অঞ্চলের মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তান অর্জনের লক্ষ্যে মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপক ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য ভাসানীর অব্যাহত প্রচেষ্টা ছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও সাংগঠনিক ব্যাপারে তাঁকে মুসলিম লীগের ভেতরেও অত্যন্ত সোচ্চার হতে হয়েছিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে। মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে সামন্তবাদী ও নব্য পুঁজিপতিদের শক্তিশালী অবস্থানের বিরুদ্ধে যে কয়জন নেতা গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন একজন অন্যতম প্রধান নেতা।
পাকিস্তান অর্জনের পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বের মধ্যে ওপরোলি্লখিত শ্রেণী ক্রমেই প্রাধান্য পেতে থাকলে এক হাজার মাইলের ব্যবধানে পূর্ব পাকিস্তানের কৃষককুল, শ্রমিক শ্রেণী ও সাধারণ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে শোচনীয়ভাবে বঞ্চিত হতে শুরু করে। ভাসানী সে ধারার অপশাসন, শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাজনীতিগতভাবে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এর সভাপতি হিসেবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন শামসুল হক (টাঙ্গাইল)। পরে ১৯৫৩ সালের ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে সংগঠনের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে তাকে পাকিস্তানভিত্তিক একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত করা হয়। তবে মওলানা ভাসানীর কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা ছিল না। রাষ্ট্রে ধর্ম পালনের ব্যাপারে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। তা ছাড়া পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য ভাসানী অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে গঠিত 'সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটির' সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে অন্তরীণ। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধেও কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি।
এভাবে রাজনৈতিক অরাজকতা, অর্থনৈতিক চরম বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বিরোধ ও প্রায় সব ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী মনোভাবের কারণে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমে একটি আধা-উপনিবেশ ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক জনপদে রূপান্তরিত হয়েছিল। তখন অতি অল্প সময়ের মধ্যে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগ তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিল। সে অবস্থায় ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন ঘনিয়ে এলে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি 'যুক্তফ্রন্ট' গঠন করেছিলেন। সে নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল এবং তার প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন ফ্রন্টের তরুণ ছাত্রনেতা খালেক নওয়াজ খানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু তখনই শুরু হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের আরেক ষড়যন্ত্র। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তখন কেন্দ্রের চাপের মুখে মওলানা ভাসানী ছাড়া প্রায় সবাই পশ্চিম পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। সে অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ আগস্ট আহূত কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বিদায় জানিয়েছিলেন, 'আস্সালামু আলাইকুম' বলে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে ধারায় পাকিস্তান চলছে তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে দীর্ঘদিন সে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বিরোধ দেখা দিলে এবং শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী মার্কিন নেতৃত্বাধীন 'সেন্টো' ও 'সিয়াটো' প্রতিরক্ষা জোটে যোগ দিলে মওলানা ভাসানী তাঁর গড়া আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে প্রগতিশীল বামধারার 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' গঠন করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৬৫ সালে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় গণচীনের অনুকূল পররাষ্ট্রনীতির কারণে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে ভাসানী কিছুটা সমর্থন দিলেও পরে তিনি তাঁর সে সাময়িক অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান। আইয়ুব সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কিছু পূর্ব পাকিস্তানির বিরুদ্ধে দায়ের করা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং তাঁর (আইয়ুব খান) স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন মওলানা ভাসানী। ছাত্র-জনতার ব্যাপক সমর্থন ও তাঁর আপসহীন আন্দোলনের ফলে পতন ঘটে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের। এরই মধ্যে দেশে (পূর্ব পাকিস্তান) দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব। এর আগে ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। খাদ্যের দাবিতে ভাসানী অনশন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। এ অবস্থায়ই ১৯৭০ সালে নির্বাচন দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহসহ বিভিন্ন দাবিতে মওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তখন পূর্ব পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শুরু হয় আবার এক নতুন ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রশ্নে শুরু হয়েছিল নানা টালবাহানা। ভাসানী বহু আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এর পরিণতির কথা। সে কারণেই তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বহু আগেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কথা বহু সভায় বহুভাবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু একটি সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন রণনীতি ও রণকৌশল অনুযায়ী।
পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'হুজুর' নামে পরিচিত কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একজন পরম ধার্মিক ব্যক্তি হয়েও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে ১৯৭৬ সালে ৯৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল তাঁর রাজনীতির অনেক ঊধর্ে্ব পিতা-পুত্রের মতো সম্পর্ক। জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে ভাসানী গঠিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা তাঁর নেতৃত্বে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের জন্য সংগ্রাম করেছেন। সামন্তবাদ কিংবা উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা আধিপত্যবাদ- সব ধরনের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন বাংলাদেশের গণমণ্ডলের এ অলৌকিক পুরুষ। দেশের গণমুখী বিভিন্ন ধারার সংগঠনের নেতা-কর্মীর কাছে তিনি ছিলেন মহীরুহের মতো। একটি উন্নয়নকামী দরিদ্র দেশের কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যে ধরনের আপসহীন, সৎ ও প্রজ্ঞাবান নেতা প্রয়োজন, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রকৃত উদাহরণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দরিদ্র, শোষিত, বঞ্চিত ও অধিকারহারা মানুষকে টেনে তোলার লক্ষ্যে নিবেদিত ছিল তাঁর সারা জীবনের রাজনীতি। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যই তাঁকে জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তিনি রাজনীতি করেও কখনো দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রীর পদ অথবা ক্ষমতার জন্য লালায়িত ছিলেন না। আমাদের জাতীয় জীবনে এ নির্লোভ, স্বার্থহীন ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষটি ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। তিনি তাঁর নীতি ও আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তাঁর জীবনে সম্পদ কিংবা বাড়ি-গাড়ির কোনো চাহিদা ছিল না। আমাদের রাজনীতিকরা যদি তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পথ চলতে পারতেন, জাতি হিসেবে আমরা তাহলে অনেক এগিয়ে যেতে পারতাম। ভাসানীর ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা যেন তাঁকে স্মরণ করি। আমরা যেন তাঁকে ভুলে না যাই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.