পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া- ‘অতীত’ নয়, ১৯৭১ অস্তিত্বের ইতিহাস by জোবাইদা নাসরীন

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক ডি-৮ সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তানে যাচ্ছেন না। এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। কিন্তু এর আগের ঘটনাবলি আরও গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীকে সম্মেলনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে ৯ নভেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার।


বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যকার কিছু ‘অমীমাংসিত বিষয়’ মীমাংসার প্রসঙ্গ পাড়েন। কিন্তু এই বিষয়ে হিনা রাব্বানি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা এ দেশের মানুষের কাছে মোটেও আকাঙ্ক্ষিত নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, হিনা রাব্বানি বলেছেন, তাঁরা অতীত ভুলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চান। কিন্তু কোন অতীত ভোলার কথা বলছেন হিনা? যে দেশে বিচার চলছে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের, সেখানে হিনা কোন ধরনের অতীত ভোলার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন?
হিনা রাব্বানি নিশ্চয়ই জানেন, সব ইতিহাসই হয়তো ‘অতীত’ জড়ানো, কিন্তু সব ‘অতীত’ ইতিহাস নয়। তাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে কখনো অতীতের কথামালা নয়, বরং ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল। হিনার দেশের সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে এ দেশের মুক্তিকামী জনতার ওপর যেভাবে নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই ঘটনা ভুলতে বলছেন তিনি ‘অতীত’ বিশেষণের একটি সীমারেখা টেনে? ১৯৭১ বাংলাদেশের মানুষের জন্য কখনো অতীতের বিষয় হবে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যত দিন থাকবে, ১৯৭১ সালের সেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাস হাঁটবে তার পাশে পাশে। পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের সব গণতন্ত্রমনা মানুষের দাবি। কিন্তু পাকিস্তান নিশ্চুপ। পাকিস্তানের যা লজ্জাজনক ‘অতীত’, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্য তাই গৌরবের ইতিহাস। নির্যাতকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরির ইতিহাস। ৪১ বছরের মধ্যে পাকিস্তান একবারের জন্যও ক্ষমা চায়নি। সেই ক্ষমা না চাওয়ার, সেই অতীত ভোলার কথা বলেছেন কি হিনা? নাকি ১৯৭১ সালে পৃথিবীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ক্ষত ভুলে যাওয়ার কথা বলছেন? যদিও হিনার কথায় সেই ‘অতীত’-এর জন্য লজ্জা বা দুঃখবোধের রেশ ছিল না। পাকিস্তান যদি ১৯৭১ সালের সেই নির্যাতন নিয়ে, হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ক্ষমা না চায়, তাহলে ধরেই নিতে হবে, পাকিস্তান এখন পর্যন্ত এই নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণের ইতিহাসকে বৈধ মনে করছে।
হিনা রাব্বানি, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করেছে, তা কি আসলে ভুলে যাওয়ার মতো ‘অতীত’? ‘লিবারেশন’-‘সেপারেশন’-এর দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য ‘ইতিহাস-অতীত’কেন্দ্রিক বোঝাপড়াকেও সামনে আনে। যে কারণে এখনো পাকিস্তানিদের অনেকের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম ‘সেপারেশন’-এর অংশ হিসেবে। তাই এই হিনার গলা ঝাড়া এই ‘অতীত’ তো কোনো সাধারণ গতকালের মতো ‘অতীত’ নয়। এই অতীত একটি ইতিহাস, যে ইতিহাস ভোলা যায় না, ভোলার কথা না। যারা সেটি করতে বলে, তার মানে হলো, তারা স্পষ্টতই এখনো বাংলাদেশকে মানতে পারছে না।
এ দেশের জনগণ কী করে ভুলবে সেই ভয়াল ২৫ মার্চকে? ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের কাছে কোনো সংখ্যা নয়, কোনো একটি সাধারণ সাল নয়, এ দেশের মানুষের কাছে এটি অনেক কিছুর স্মারক। আর বেশির ভাগ মানুষের জন্য সেটি ছিল সবচেয়ে কঠিন সময় এই ’৭১, বেঁচে থাকার লড়াই। ১৯৭১ সালের ভয়াল সেই ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছে, সেটি ভুলে গেলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব কি টিকে থাকবে? এই হত্যাযজ্ঞ আমরা কীভাবে ভুলব?
নয় মাসজুড়ে যে গণহত্যা করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সেই নির্যাতন আমরা কীভাবে ভুলব? ধর্ষণের শিকার এত এত নারীর অপমানিত মুখ আমরা কীভাবে মন থেকে ঝেড়ে ফেলব? পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পর সেনা ক্যাম্পগুলোতে যে সারি সারি লাশ, নারীর চুড়ি, শাড়ি, অত্যাচারের নমুনা পাওয়া গেছে, আমরা সেগুলো কেমন করে ভুলব? রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর বধ্যভূমিসহ দেশের হাজার হাজার বধ্যভূমির লাশের দুঃসহ স্মৃতি এবং স্বজন হারানোদের বেদনা ও জীবনসংগ্রামকে কীভাবে ভুলব? লাখ লাখ শরণার্থীর আর্তনাদ, মৃত্যু এবং দুঃসহ জীবনকে কী উপায়ে ভুলব আমরা? পিরোজপুরের ভাগীরথী সাহাকে জিপের পেছনে বেঁধে পিচঢালা রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা, ভাগীরথীর মতো লাখ লাখ মানুষের সেই অভিজ্ঞতা কী করে ভুলব? পার্বতীপুরের হোসনে আরাকে যে ট্রেনের গরম চুল্লির মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা নিক্ষেপ করেছিল, সেই ক্ষত কী করে ভুলব?
এই ৪১ বছরেও ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। বাংলাদেশ থেকে বারবার ক্ষমা চাওয়ার দাবি করা হলেও এখনো ধৃষ্টতা দেখিয়ে চলছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। অথচ পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ডন তাদের ১১ নভেম্বর প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে ঢাকার কাছে ইসলামাবাদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে। পত্রিকার সম্পাদকীয়টিতে পাকিস্তানকে ‘পরিপূর্ণ ক্ষমা চাওয়ার’ বিষয়টি জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়। শুধু এটিই নয়, ক্ষমা চাওয়াকে পাকিস্তানের একটি ‘সাহসী’ পদক্ষেপ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনাকে ইঙ্গিত করেনি।
অতীতের কৃতকর্মকে ভুলে যাওয়ার অনুরোধের বদলে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে অনেক আছে। জাপান কোরিয়ার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছে দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিকতার জন্য। শুধু ক্ষমা চাওয়াই নয়, এখনো জাপান কোরিয়াকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাচ্ছে। জাপানের এই পদক্ষেপ বিশ্বের কাছে নন্দিত হয়েছে। পাকিস্তানের কাছে কবে এই ‘অতীত’ ক্ষমার চাওয়ার ইতিহাস হয়ে উঠবে, সেই দিনের অপেক্ষায় আছে এ দেশের জনগণ। তবে পাকিস্তানকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতেই হবে।
 জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreegmail.com

No comments

Powered by Blogger.