কালের পুরাণ- খালেদা জিয়া পারবেন কি? by সোহরাব হাসান

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ধন্যবাদ। তিনি বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট নেবে না। জামায়াতে ইসলামী একটি আলাদা দল, তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে কর্মসূচি নিয়েছে, সেই কর্মসূচির সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।


এ সময় বিএনপির কোনো কর্মসূচিও ছিল না। তবে মির্জা সাহেব দেশবাসীকে এ কথাও জানিয়েছেন যে সরকার জামায়াতে ইসলামীকে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে উসকানি দিচ্ছে। অর্থাৎ সরকারের উসকানিতেই জামায়াতের কর্মীরা পুলিশের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আবার তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে!
তার পরও আমরা বিএনপির মহাসচিবের এই বক্তব্যকে ইতিবাচক বলে মনে করি। প্রথমত, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন যে জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দলটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে এবং তার দায় তারা (বিএনপি) নেবে না। বিএনপির অনেক নেতার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোর যে প্রবণতা আছে, আলমগীরের বক্তব্য তার থেকে ভিন্ন। একসময় তিনি বামপন্থী রাজনীতি করতেন। সে কারণেই সম্ভবত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পুরোপুরি একাত্ম হতে পারেন না। বিএনপিতে ডান-বামের বিরোধটা যে একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি, মির্জা সাহেব সে কথাই আবার আমাদের জানিয়ে দিলেন।
এ প্রসঙ্গে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে গেল শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে জামায়াতে ইসলামীর পোষ্য সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির শিক্ষাঙ্গনে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তার অন্যতম টার্গেট ছিল বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিএল কলেজসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবিরের ক্যাডারদের হাতে ছাত্রদলের বহু কর্মী খুন হয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিশ্চয়ই বলবেন না যে তখন বিএনপি বা ছাত্রদল শিবিরকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে উসকানি দিয়েছিল।
রাজপথে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ এক কথা, আর পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চড়াও হওয়া কিংবা তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া ভিন্ন কথা। এই সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনী বহুবার বিএনপির অফিস ঘিরে রেখেছে, মিছিলে লাঠিপেটা করেছে, অফিসের ভেতরে গিয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু তার জবাবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা তো পুলিশের ওপর এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, ইট-পাথর মেরেও কাউকে রক্তাক্ত করেনি, কিংবা পুলিশের গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রত্যুষে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের নামে যে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছিল, তার নেতৃত্বেও নাকি জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ছিল।
রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে বিএনপি ডান পন্থার দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে দেয়ালে পিঠ ঠেকালেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিশে যায়নি; শত দুর্বলতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটো দলই নড়বড়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দর্শন ও চিন্তার সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মিল নেই। ধর্মকে পুঁজি করে তাদের রাজনীতি এবং তারা নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। একাত্তরই তাদের অন্যায় অপকর্মের একমাত্র উদাহরণ নয়। ১৯৫৩ সালে আহমদিয়া জামায়াতের বিরুদ্ধে এই দলটি দাঙ্গা লাগিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করেছিল। এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন স্থানে রগ কাটা ও হাত কাটার রাজনীতিও তারা শুরু করেছিল। যেই দলটির রাজনৈতিক দর্শনে সন্ত্রাস ও জবরদস্তি আছে, সেই দলটি কী করে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে?

২.
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক কথাবার্তা ও আচরণে নিজেকে মডারেট বা পরমতসহিষ্ণু প্রমাণ করার চেষ্টা আছে। তাঁর ভারত সফর যেসব কারণে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো বিএনপির আগের অবস্থানের পরিবর্তন। নয়াদিল্লিতে ভারতীয় নেতাদের কাছে তিনি এই অঙ্গীকার করে এসেছেন যে ‘ভবিষ্যতে তাঁর দল ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। বাংলাদেশের মাটি ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর কাজে ব্যবহূত হতে দেবেন না।’ আমাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর এই অঙ্গীকার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে তিনি যেমন ভারতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন, তেমনি যেই অদৃশ্য বিদেশি শক্তির অপচ্ছায়া তাঁদের বিপথে চালিত করেছে, সেই অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসারও আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু মৌলবাদী দলটির পক্ষে সেই অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব।
কোনো কোনো পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপির নেত্রী ভারতীয় নেতাদের কাছে মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথাও বলেছেন। এসব প্রতিবেদন যদি সত্যি হয়, তাহলে জামায়াতে ইসলামীর ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে খালেদা জিয়া অতীতের ভুল সংশোধনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সেই সম্প্রীতি তিনি কাদের নিয়ে করবেন? তাঁর আশপাশে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরোধী লোক। দলের ও জোটের ভেতরে এই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী আদর্শের লোকজন যত দিন থাকবে, তত দিন দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হবে না। ভারতে বিজেপিকে যেমন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তাড়া করে ফিরছে, তেমনি বাংলাদেশে বিএনপিকে তাড়া করছে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। গণতান্ত্রিক দল কিংবা জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে এটি বিএনপির বড় ব্যর্থতা। খালেদা জিয়া কি দলকে, জোটকে এই অশুভ চক্রের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবেন?

৩.
বিএনপির নেতারা বলার চেষ্টা করছেন, জামায়াতে ইসলামী একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সভা-সমাবেশ করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার প্রয়োগের নামে তো তারা জনগণের নিরাপত্তা বিনষ্ট করতে পারে না। চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করতে পারে না।
এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামীর দাবি কী? যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন আটক নেতাদের ছেড়ে দিতে হবে। বিচার চলছে এক-দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে। সেই বিচার-প্রক্রিয়া মেনেই আসামিরা আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নামকরা আইনজীবী নিয়োগ করেছেন। এত দিন এসব নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। কিন্তু বিচার-প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে এসে দলটি কেন মরিয়া হয়ে উঠল? এখন জামায়াত ও শিবিরের নেতা-কর্মীরা সভা-সমাবেশের নামে যা করছেন, সেটি সন্ত্রাস ছাড়া কিছু নয়। ১৯৭১ সালে দলটি যে জঘন্য অপরাধ করেছিল, সেটি ঢাকতে এবং অপরাধীদের বাঁচাতে তারা মাঠে নেমেছে। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে।
এই অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্ব, আরও নির্দিষ্ট করে বললে খালেদা জিয়া কী করবেন? তিনি কি পারবেন জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতার বিপক্ষে অবস্থান নিতে? তিনি কি পারবেন যুদ্ধাপরাধীদের নিজের দল থেকে বের করে দিতে? বিএনপিতেও বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন। আছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষও। বিএনপির যেসব নেতা-কর্মী একাত্তরে রাজাকার-আলবদরদের হাতে মার খেয়েছেন কিংবা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা কি কখনোই যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করতে পারবেন? সেদিন যদি জিয়াউর রহমান বা সাদেক হোসেন খোকা পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা আলবদর-রাজাকারের হাতে ধরা পড়তেন, তাহলে কি তাঁরা জীবিত ছাড়া পেতেন? অবশ্যই পেতেন না। তাই যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিটি দলীয় নয়। এটি গোটা জাতির দাবি। সমগ্র জনগণের এ দাবিকে খালেদা জিয়া কী করে উপেক্ষা করবেন?

৪.
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে ঝগড়া আছে, তা চলবে। চলুক। বিরোধী দলের ওপর সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদও তারা করবে। করুক। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরনসহ হাজারটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। হোক। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার বিতর্কের বিষয় হতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে কোনো গণতান্ত্রিক দল বা গণতন্ত্রমনা মানুষের সম্পর্ক থাকতে পারে না। বিএনপি যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যদি তারা আইনের শাসনে আস্থাশীল হয়ে থাকে, তাহলে যেসব যুদ্ধাপরাধী আছেন, তাঁদের সংস্রব ত্যাগ করতে হবে। সেটি হোক দলের কিংবা জোটের। যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নে বিএনপিকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। বিএনপির নেত্রীকে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে—গণতন্ত্র, ন্যায় ও আইনের শাসন অথবা কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী?
আমরা জানি, খালেদা জিয়া মোটেই অপরিপক্ব রাজনীতিক নন। ১৯৮৩ থেকে ২০১২ সাল—এই ৩০ বছর তিনি দেশের অন্যতম বৃহত্তম দলটির নেতৃত্বই দেননি, দুই-দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন। এরশাদের আমলে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন। এরশাদ বিএনপির অনেক নেতাকে ভাগিয়ে নিয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া নতিস্বীকার করেননি। আপসহীন ছিলেন। কিন্তু এবারে কি সেই আপসহীন নেত্রী গুটি কয়েক যুদ্ধাপরাধীর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন? জাতীয়তাবাদী দলের সব নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জন দেবেন?
আজ যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে, খালেদা জিয়া কোন দিকে যাবেন? তাঁর সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রতীয়মান হয়, তিনি উদার ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থারই পক্ষে অবস্থান নেবেন। অতীতের ভুলগুলো সংশোধন করবেন। অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে সৌহার্দ্যের সেতু গড়ে তুলবেন। কিন্তু সেটি তো মৌলবাদী ও চরমপন্থী আদর্শের ধারক জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে সম্ভব নয়।
মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গিবাদী চক্র কিংবা তার অপচ্ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দলকে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। বিএনপির নেত্রী পারবেন কি সেই দাবি পূরণ করতে?
 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.