সুভাষ দত্তের মহাপ্রয়াণ-জাতি তাঁকে যুগ যুগ স্মরণ করবে

বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রবাদ পুরুষকে আমরা হারালাম। শক্তিমান অভিনেতা, সৃষ্টিশীল পরিচালক ও শিল্পবোদ্ধা সুভাষ দত্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। গত শুক্রবার সকাল ৭টা ১০ মিনিটে নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


অত্যন্ত উঁচুমাপের এই শিল্পীর প্রয়াণে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা পূরণ হওয়ার নয়।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পথের পাঁচালী তাঁকে পথ দেখিয়ে দেয় চলচ্চিত্র জগতের। একজন দর্শক থেকে হয়ে যান অভিনেতা। পোস্টার আঁকা থেকে শুরু করে অভিনয়, সবশেষে ছবি পরিচালনার মতো নানা দিকে তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। তাঁর অভিনীত এই দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, তালাশ, সুতরাং-এর মতো অনেক ছবি দর্শকের মনে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণ যুগখ্যাত ষাটের দশকে আবির্ভাব মানুষকে নতুন করে সিনেমার জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তাঁর নির্মিত (১৯৬২) এই ছবি শুধু দর্শককেই মুগ্ধ করেনি, বাংলা চলচ্চিত্রকে বহির্বিশ্বেও বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ফ্রাংকফুট ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হয় ছবিটি। কম্বোডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠানো হলে সেখানেও বিশেষ পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হয়। আবির্ভাব, সুতরাং, নৌকা, পালাবদল, আলিঙ্গন, আয়না ও অবশিষ্ট, বিনিময়, আকাঙ্ক্ষা, বসুন্ধরা, ডুমুরের ফুল, সকাল সন্ধ্যা ও ফুলশয্যার মতো সফল ছবির পরিচালক হিসেবে তিনি দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
উর্দু সিনেমার রমরমা সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে দর্শকের সামনে সমহিমায় হাজির করার ক্ষেত্রে যে কয়জন নির্মাতা ও অভিনেতার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, নিঃসন্দেহে সুভাষ দত্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অচেনা পরিবেশ, অচেনা ভাবনার জগৎ থেকে বাংলাদেশের দর্শকের আপন জগৎকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য, আমাদের বাংলা সিনেমাকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। তিনি এমন একসময় এই জগতে প্রবেশ করেন যখন মানুষ সিনেমা বলতেই উর্দু আর হিন্দিকে প্রাধান্য দিত। সাধারণ দর্শকের মধ্যে ধারণা ছিল বাংলায় বুঝি ভালো কোনো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ওই সময় তিনি অভিনেতা হিসেবে মানুষকে প্রাণ খুলে হাসির সুযোগ করে দিলেন। এরপর প্রমাণ করে দিলেন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণেও অনেক পরিপক্ব। শুধু তাই নয়, তিনি আরো প্রমাণ করলেন বাংলা চলচ্চিত্রাঙ্গনে নতুনদেরও বিশাল কিছু দেওয়ার আছে। তাঁরাও পারে উর্দু কিংবা হিন্দি সিনেমার মতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালো কিছু উপহার দিতে। তারই প্রমাণ রেখেছেন কবরীর মতো শিল্পীকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমে। স্পষ্টতই মনে করা যায়, তিনি শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি।
দর্শকনন্দিত এই শিল্পী রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার হিসেবে একুশে পদক লাভ করেন। সেরা চলচ্চিত্রকার হিসেবেও তিনি বহুবার পুরস্কৃত হয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রাঙ্গনে তাঁর সৃষ্টিগুলো তাঁকে দীর্ঘকাল জীবিত রাখবে। আমরা তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

No comments

Powered by Blogger.