ড্র খুবই সম্ভব, এমনকি জয়ও by সাইদুজ্জামান

সংবাদমাধ্যমের সামনে এখনো গুছিয়ে কথা বলাটা রপ্ত করে উঠতে পারেননি নাসির হোসেন। তবে রংপুরের এ তরুণের উত্তরের ভাবার্থ বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫২৭ রান তাড়া করে যে এগিয়ে যাওয়ার কথা- ইনিংসের শুরুতে ভাবেনি বাংলাদেশ। আর গতকাল চতুর্থ দিনের শেষ ঘণ্টায় জেগে ওঠা 'নতুন সম্ভাবনা' তো রীতিমতো কল্পনাতীত ব্যাপার।


সফরকারীদের ২১৫ রানের লিডকে খুব বেশি বাড়তে না দিলে জিতেও যেতে পারে বাংলাদেশ। প্রথম দিন উঁকি দেওয়া ইনিংস ব্যবধানে হারের আশঙ্কা চতুর্থ দিনের বিকেলে কোথায় যে মিলিয়ে গেল! ড্র ও নিষ্পত্তি- দুটি সম্ভাবনা নিয়েই আজ মাঠে গড়াচ্ছে ঢাকা টেস্টের শেষ দিনের খেলা।
নাসিরের মতো স্বল্পবাক প্রথমবারের মতো টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করা ক্যারিবীয় ওপেনার কিয়েরান পাওয়েলও। তবে ম্যাচের এ অবস্থায় কি বাংলাদেশ কর্তৃত্ব করছে- প্রশ্নটি শুনে ঠিকই ফোঁস করে ওঠেন উনিশের এ তরুণ, 'আমি তা মনে করি না। কাল আমরা ৩০০ রানের লিড নিলেই হবে।' ৬ উইকেটে ২৪৪ থেকে পাওয়েলের প্রত্যাশা পূরণে আরো ৮৫ রান করতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
আজ ব্যাটিংয়ে নামতে বাধা নেই এই টেস্টের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিয়ান শিবনারায়ণ চন্দরপলের। তাতে ক্যারিবীয়দের জন্য ৩০০ রানে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু এ জন্য আবার সময় দরকার, অন্তত একটা সেশন তো বটেই। এরপর দিনের শেষ চার ঘণ্টায় কি বাংলাদেশকে অলআউট করা সম্ভব? পাওয়েল সম্ভব মনে করছেন, 'উইকেটটা অন্য রকম ব্যবহার করছে। খুব বেশি টার্ন নেই, তবে বাড়তি বাউন্সের সঙ্গে বল থেমে থেমে আসছে।' সেই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আগাছা নিধনের মতো বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস মুড়িয়ে দেবে- ক্যারিবীয়দের 'থট রিডিং' মোটেও কঠিন নয়! তবে পাওয়েলের অঙ্কটা ভুল প্রমাণের সম্ভাবনাই কি একটু বেশি নয়? কাল বিকেলে বদলে যাওয়া উইকেট যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে বোলার সাকিব আল হাসানকে, তাতে চতুর্থ ইনিংসের টার্গেটটা বাংলাদেশের জন্য সহজ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সেই সম্ভাবনা মিরপুর স্টেডিয়ামে সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠা ফ্লাড লাইটের মতোই আলোকিত। কিন্তু গ্যালারির বাইরেই নিকষ অন্ধকার, যেন ওত পেতে আছে দুঃস্বপ্ন! উইকেট অবশেষে চরিত্র বদলাতে শুরু করেছে। পঞ্চম দিনে তা আরো বদলাতে বাধ্য। দ্বিতীয় ইনিংস নিয়মিত অস্বস্তিতে ভোগা বাংলাদেশ দলের জন্য তো তখন ২৫০-ও অনেক রান! তাই আলোয় স্নান করার আগে অন্ধকার দূরে ঠেলে দেওয়াই নাসির, তথা বাংলাদেশ দলের আজকের রণপরিকল্পনা, 'আগে ম্যাচটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। সেটা সফল হলে পরে পরেরটা দেখা যাবে।' এর মানে, বাংলাদেশের ভাবনায় জয় আছে ঠিকই, তবে প্রথম চিন্তা হার এড়ানো। ফ্ল্যাশব্যাকে ঢাকা টেস্টের প্রথম বল থেকে ঘুরে এলে 'ড্র' জয়ের চেয়েও কম কিসে! অথচ কাল খেলা শুরু হয়েছিল সম্ভাব্য ড্রকে মাথায় রেখেই। একটু ভুল বলা হলো। পছন্দের উইকেটে নিশ্চিন্তে ব্যাট করার সুযোগ খুব কমই পান বাংলাদেশের পরের ব্যাটসম্যানরা। মাহমুদ উল্লাহ ও নাসির সে সুযোগের সদ্ব্যবহারও করেছেন। ইনিংসে দ্বিতীয় শতরানের জুটি গড়ার পর সুনীল নারিনের টার্নে হার মানেন মাহমুদ উল্লাহ, ততক্ষণে সর্বোচ্চ টেস্ট ইনিংসের নতুন রেকর্ড লিখে ফেলেছে বাংলাদেশ। প্রথম বলটাই বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে জাতীয় লিগে নিজের দুটি সেঞ্চুরির কথা মনে করিয়ে দেন সোহাগ গাজী। কিন্তু নারিনের ওই ওভারেই তাঁর বিদায়ে বাংলাদেশের ক্ষতিটা নেমে আসে ব্যক্তিগত পর্যায়ে, ৯৬ রানে নাসিরের আউট হয়ে যাওয়া। টেল এন্ডারদের আগলে রাখার চেষ্টায় টিনো বেস্টের অনেক দূরের বলে ব্যাট লাগিয়ে প্রান্ত বদল করতে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয় নাসিরের। অবশ্য ম্যাচ পরিস্থিতির কারণে ওই বেদনার ছাপ নেই তাঁর অভিব্যক্তিতে।
এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে শেষ ঘণ্টায়। ২৯ রানে পিছিয়ে থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর সময়ও যে পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না কেউ। ক্রিস গেইল টানা দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় উইকেটে পাওয়েল ও ড্যারেন ব্রাভোর ১৮৯ রানের জুটির কর্তৃত্ব দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি লিডটাকে দ্রুত বাড়িয়ে নিতে টোয়েন্টি টোয়েন্টির ব্যাটিং শুরু করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু প্রথমে পাওয়েলকে ফেরান রুবেল হোসেন। এরপর সোহাগ গাজী ও সাকিবের স্পিনে নিমেষেই পাল্টে যায় ম্যাচের ভারসাম্য। মাত্র ৩৫ রানের ব্যবধানে ক্যারিবীয় ৫ উইকেট তুলে নেন বাংলাদেশি বোলাররা। সাকিব-সোহাগের দাপটের কথা বলা হয়েছে। দারুণ বল করে জোড়া উইকেট নিয়েছেন প্রথম ইনিংসে নিষপ্রভ রুবেল হোসেন। স্রেফ দুর্ভাগ্যের জন্যই শিকার মেলেনি শাহাদাত হোসেনের। পাওয়েলের উইকেটটা তাঁরই প্রাপ্য ছিল। কিন্তু ক্যারিবীয় এ ওপেনারের ব্যক্তিগত ১৭ রানে দেওয়া সহজ ক্যাচটা ফেলে দেন স্লিপে দাঁড়ানো জুনায়েদ সিদ্দীক। এর আগে আরেকটি ক্যাচ গিয়েছিল জুনায়েদের দিকে। কিন্তু গেইলের ব্যাট হয়ে আসা সেই উঁচু ক্যাচ এক হাতে ধরতে গিয়ে পারেননি তিনি! অবশ্য এ জন্য জুনায়েদকে তিরস্কার করার উপায় নেই। কারণ স্লিপে তিনিই দেশসেরা। কথিত আছে, ওই পজিশনে অন্য কেউ দাঁড়াতেও চান না! আবার উন্নতির চেষ্টা আছে বলেই দিন শেষে অন্যরা 'কুল ডাউন' হয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরে গেলেও দীর্ঘক্ষণ স্লিপ ক্যাচিং অনুশীলন করেছেন জুনায়েদ।
চারটি দিন তো দারুণ কাটল। কিন্তু পঞ্চম দিন? আশা করা যাক, এদিন আর কোনো ক্যাচ ফেলবেন না জুনায়েদ কিংবা অন্য কেউ। আগের চারটি ভালো দিনের আনন্দ আজ মাটি করে দেবেন না মুশফিকুর রহিমরা। বরং আর দুটি উইকেট নিলেই মোহাম্মদ রফিকের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে শিকারের 'সেঞ্চুরি' হয়ে যাবে দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিবের। ক্রিকেট মাঠে আসার আগে অনেক আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে হয় দর্শকদের। আজকের সে প্রস্তুতিতে নিশ্চিতভাবেই থাকছে সাকিবের নামাঙ্কিত কিছু প্ল্যাকার্ড।
কাকতালীয়ভাবে আজ মিরপুর স্টেডিয়ামে আসছেন আইসিসির নতুন সভাপতি অ্যালান আইজাক। মাঠে বাংলাদেশের কর্তৃত্ব আর গ্যালারিভরা উৎসবমুখর দর্শক- বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থার প্রধানকে আতিথ্য দেওয়ার এর চেয়ে ভালো 'উপঢৌকন' আর কী হতে পারে!

* প্রথম পাঁচ শ : টেস্টে প্রথম ৫০০ রানের মাইলফলক পেরিয়েছে বাংলাদেশ। ৫৫৬ রান করে পেয়েছে ২৯ রানের লিডও।
* তারপর দুর্দান্ত বোলিং : শেষ বিকেলে সাকিব, রুবেল ও সোহাগ ৩৫ রানে ৫ উইকেট তুলে নেওয়ায় জয়ের পাল্লা কিছুটা হলেও ভারী।
* এখন দারুণ সম্ভাবনা : ৬ উইকেট হারিয়ে উইন্ডিজের লিড ২১৫ রানের। আজ দ্রুত ৪ উইকেট তুলে নিলে জয়ের পেছনেও ছোটা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.