রাহুল সতর্ক, সাবধানী সোনিয়া by অমিত বসু

অল্প ভিতে বেশি ওপরে মাথা তুলতে গিয়ে বিপদ। ইতালিতে জন্ম বলে সোনিয়া গান্ধী এই ভুলের সঙ্গে পরিচিত। ভ্রান্তিবিলাস ধাতে সয় না। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যাসাদে পড়তে রাজি নন। যা করেন, সবই ভেবেচিন্তে।


পা ফেলেন হিসাব করে। ১৯৯১-এর ২১ মে চেন্নাই থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে শ্রীপেরুমপুদুরে বোমা বিস্ফোরণে রাজীব গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তাঁকে কংগ্রেস সভানেত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আর্জি জানানো হয়, তিনি এড়িয়ে গেলেন। সাত বছর পর ১৯৯৮-এর ১৩ মার্চ তিনি সেই দায়িত্ব নিলেন। এত দেরি করলেন কেন? সুযোগ এলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, সেটা তিনি মনে করেননি। পেলেই নেওয়া নয়, আগে দেখা দরকার যেটা নিছক সেটা রাখতে পারবেন কি না। লোভে পড়ে নিলে হারানোর শঙ্কা বেশি। যোগ্য হয়েই নির্দিষ্ট পদে আসীন হওয়া ভালো। ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছেন। হিন্দি শিখেছেন। দেশটাকে জেনেছেন। যখন বুঝেছেন পদের মর্যাদা রাখতে পারবেন, তখনই কংগ্রেসের শীর্ষ চেয়ারে বসেছেন।
কংগ্রেস সভানেত্রী হওয়ার আগে তিনি দৃষ্টান্তমূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই বছরের গোড়ায়ই ২৮ জানুয়ারি রাজীব হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ২৬ জনকে যখন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো, তিনি বিরুদ্ধাচরণ করলেন। দোষীদের মৃত্যুদান সমস্যার যথার্থ সমাধান বলে মনে করলেন না। প্রতিশোধস্পৃহা ছেড়ে মানবিকতার রাস্তায় হাঁটলেন। ঠিক বিপরীত কাজ করেছিলেন রাজীব গান্ধী। শ্রীলঙ্কায় শান্তিবাহিনী পাঠিয়ে তামিল টাইগারদের শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন। তা হয়নি। উল্টো তাদের হাতেই প্রাণনাশ। একইভাবে ইন্দিরা গান্ধীকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। ১৯৮৪-এর ৫ জুন অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে ইন্দিরা নির্দেশিত ব্লু স্টার অপারেশনে খালিস্তানি নেতা জার্নেল সিং ভিন্দ্রাসওয়ালের মৃত্যু। নিহত তাঁর ৩২৫ সহযোগী। চার মাস পর ৩১ অক্টোবর দিলি্লর বাসভবনে নিজের নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা নিহত। ইন্দিরা-রাজীবের ঘটনা সোনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, জঙ্গিরা আক্রান্ত হলে প্রতিশোধ নেবেই। মৃত্যুর বদলে মৃত্যুতেই তারা অভ্যস্ত। তাদের নিরস্ত্র করতে অন্য পথে হাঁটতে হবে। দরকার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির। এখানেই তিনি পুরোপুরি গান্ধীবাদী। ইন্দিরা-রাজীবের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
২০০৪-এর ২০ মে সোনিয়া আরেকবার প্রকাশ করলেন তাঁর সত্তার ভিন্নতা। কংগ্রেসের সবাই যখন তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইলেন, তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সেই দায়িত্ব তুলে দিলেন মনমোহন সিংয়ের হাতে। ভারত পেল প্রথম সংখ্যালঘু প্রধানমন্ত্রী। সোনিয়াকে বিদেশিনী তকমা দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছিল বিজেপি। পারল না। উল্টো সোনিয়ার ইমেজ আরো উজ্জ্বল হলো। আসন পেলেন প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও উঁচুতে। আপাতত সোনিয়াই কংগ্রেসের শিরদাঁড়া।
২০০৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারে কলকাতায় এসেছিলেন সোনিয়া। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল সমাবেশে তাঁর সঙ্গী হওয়ার কথা ছিল কন্যা প্রিয়াঙ্কার। তাঁকে আনেননি। প্রিয়াঙ্কাকে সামনে আনায় দ্বিধা ছিল। কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের ধারণা ছিল, প্রিয়াঙ্কা তুরুপের তাস। তাঁকে দিয়েই টপকানো যাবে নির্বাচনী বৈতরণী। প্রিয়াঙ্কার জনমোহিনী গ্ল্যামার ভোট অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হবে। সোনিয়া সেটা হতে দেননি। প্রিয়াঙ্কার নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় ছিল। সোনিয়া পরিবার যে আন্তর্জাতিক জঙ্গি ব্রিগেডের টার্গেট জানতেন তিনি। শ্বশ্রূমাতা-স্বামীকে হারানোর পর সন্তান সম্পর্কে তিনি ছিলেন অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন। প্রিয়াঙ্কাকে আটকে রাখলেন উত্তর প্রদেশের সাংগঠনিক কাজে। জাতীয় রাজনীতিতে এই রাজ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকসভায় আসনও সবচেয়ে বেশি। আগে ছিল ১০০। রাজ্যটি ভেঙে দুটি হওয়ার পর কমে ৮০। তা-ও কম নয়। অন্য যেকোনো রাজ্যের দ্বিগুণ। অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রী এসেছেন এই রাজ্য থেকেই। উত্তর প্রদেশের ভাঙা অংশ নিয়ে উত্তরাখণ্ড হওয়ার পরও তার বিশালতা খর্ব হয়নি।
উত্তর প্রদেশে একাধিপত্য ছিল কংগ্রেসের। প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বাড়ি এ রাজ্যেরই এলাহাবাদ শহরে। অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের বাড়িও সেখানে। তাঁর মা তেজি বচ্চন, বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন ছিলেন নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ। সেই সুযোগে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে অমিতাভের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল। সেটা ফিকে হতে হতে ক্রমেই মাটিতে মিশে যায়। এলাহাবাদ থেকে নেহরু পরিবারও ধীরে ধীরে পাততাড়ি গোটায়। ইন্দিরার দায়িত্ব বাড়ে।
১৯৫৯ সালে কংগ্রেস সভানেত্রী হওয়ার পর ১৯৬৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হলেন ইন্দিরা। তাঁর কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় গান্ধী আস্তে আস্তে কংগ্রেসের সাংগঠনিক ক্ষমতা দখল করলেন ১৯৭৫-এর পর। প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৮০ সালের ২০ জুন বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব নিলেন রাজীব গান্ধী। বিমানের পাইলট হয়ে উড়তে উড়তে হঠাৎ মাটিতে নেমে আসা। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই আচমকা প্রধানমন্ত্রী হওয়া। ১৯৯১ সালে রাজীবের মৃত্যুর পর গান্ধী পরিবারে অপরিসীম শূন্যতা। দীর্ঘ অপেক্ষায় রাহুল গান্ধীর উত্থান। তত দিনে রাজনীতির প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। কংগ্রেসের একা সরকার গঠনের শক্তি অস্তমিত। উত্তর প্রদেশও হাতছাড়া।
১৯৮৯-এর ২ ডিসেম্বর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রী হয়ে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিলেন। মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য ২৭ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। পিছিয়েপড়া মানুষের জাগরণ তখনই। কংগ্রেস থেকে যারা কিছুই পায়নি, তাদের অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে কংগ্রেসের হারানোর পালা শুরু। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে হবু প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করতে হবে। রাহুল ভিন্ন অন্য নাম ভাবাই যায় না। সুচিন্তিতভাবে দিলি্লর রামলীলা ময়দানে রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার প্রথম পর্ব শেষ। মঞ্চে সোনিয়া, মনমোহনের পাশে রাহুল। খুব সংযত, সতর্ক, পরিণত ভঙ্গিমায়।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.