স্মরণ- ভাষাসৈনিক অজিতকুমার গুহ by এ হাসান ইমাম মজুমদার

১২ নভেম্বর ছিল অজিতকুমার গুহের মৃত্যুবার্ষিকী। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাঁকে চেনেন না। কিন্তু পাকিস্তান আমলে বৈরী পরিবেশে তিনি দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিকাশে এবং মানবতার মূল্যবোধ ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে যে অবদান রেখে গেছেন, তার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।


তিনি ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার বাহক, আপসহীন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী, খ্যাতিমান বাগ্মী ও খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ।
অজিতকমার গুহের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ এ্রপ্রিল, কুমিল্লার সুপারিবাগানে। পিতা নৃপেন্দ্রমোহন গুহ। অজিতকমার গুহ ১৯৩০ সালে ঈশ্বর পাঠশালা থেকে প্রবেশিকা, ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৩২ সালে আইএ এবং ১৯৩৪ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়ান ভারনাকুলারস (ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব) বিষয়ে এমএ এবং পরবর্তী সময়ে বিটি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৪০-৪২ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে অবস্থান করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার বিরল সুযোগ লাভ করেন।
কলকাতা থেকে ফিরে ১৯৪২ সালের শেষ দিকে ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন অজিতকুমার। এখানে ছয় বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে একটানা প্রায় ২০ বছর (১৯৬৮ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত) কর্মরত ছিলেন। তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখের অনেক স্মৃতির সঙ্গে জগন্নাথ কলেজের নাম জড়িয়ে আছে। ছাত্রছাত্রীদের অপরিসীম শ্রদ্ধা, সহকর্মীদের আন্তরিকতা তিনি পেয়েছিলেন। কলেজ প্রশাসনের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অজিতকুমার গুহ শিক্ষকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত থেকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠায় নিজের শ্রম ও মেধাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার জন্য অজিতকুমার যেমন শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন; আবার এই একই কারণে সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি ১৯৪৮ সালে প্রথম কারাবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে তাঁকে ফের ১৯৫২ সালে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৫৪ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাস পর তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ সময় কারাবাস করার কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কারাজীবনের সঙ্গী ছিলেন আবুল হাশিম, অলি আহাদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রমুখ।
একজন কৃতী সাতিহ্য সমালোচক হিসেবে সর্বমহলে অজিতকুমার গুহ ছিলেন সমাদৃত। সম্পাদনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্তের অধিকারী। মেঘদূত, কৃষ্ণকান্তের উইল, গীতবিতান, গীতাঞ্জলি, সঞ্চয়িতা— এই পাঁচটি গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রকাশিত গল্প, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথার সংখ্যা অনেক। ‘কায়কোবাদ: কাব্য সৃষ্টির পটভূমিকা, ‘নজরুল কাব্যে পুরাণ’ ‘রবীন্দ্রকথা’, ‘রবীন্দ্র কাব্যে পরবর্তী পরিবর্তন’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও পদ্মা’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলো পাঠ করে বাংলা সাহিত্যে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ উপকৃত হচ্ছে। অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ ও আনিসুজ্জামান রচিত ও সংকলিত নতুন বাংলা রচনা আজও ছাত্রছাত্রীদের কাছে অতি মূল্যবান গ্রন্থ।
তিনি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও চিন্তা-চেতনায় অরাজনৈতিক ছিলেন না বলেই ১৯৬৮ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রাদেশিকীকরণ করা হলে পদত্যাগ করে কয়েক মাস বেকার জীবন যাপন করেন। এমতাবস্থায় অনেকটা অনন্যোপায় হয়ে প্রথমে টিঅ্যান্ডটি কলেজের উপাধ্যক্ষ, জুবিলী স্কুলে অবস্থিত নৈশ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে স্বল্পকালীন দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৯ সালের ১ বৈশাখ রমনা বটমূলে বাংলা ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে দেওয়া বক্তব্যকে শাসকগোষ্ঠী সামরিক আইনের ১৯ ধারা লঙ্ঘন বলে অভিযুক্ত করে ২৭ এপ্রিল উপ-আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষে মেজর মমতাজ মালিক অজিতকুমার গুহকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেন। এ ঘটনাও তিনি সাহসের সঙ্গেই মোকাবিলা করেন।
অতঃপর কয়েকজন উদারমনা শিক্ষকের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে একটি বিশেষ পদে যোগদানের বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত হলে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকা ছাড়তে সম্মত হন। চট্টগ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ১৯৬৯ সালের ১২ নভেম্বর সকালে কুমিল্লায় এসে রাতে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
অজিতকুমার গুহকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘মানুষের জীবন গ্লানিমুক্ত হোক, ভাষা তার স্বাভাবিক স্থান অধিকার করুক, গড়ে উঠুক সুস্থ সাহিত্য, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে দেশ অব্যাহতি লাভ করুক—এই ছিল তাঁর কামনা। জনপ্রিয় শিক্ষকরূপে, সচেতন নাগরিকরূপে, উৎসাহী সংস্কৃতিসেবীরূপে এই প্রেরণা তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের। এই সত্যনিষ্ঠ আদর্শপ্রিয় মানুষের সেই দান আমাদের চিত্তে স্থায়ী হয়ে রইল।’
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য অধ্যাপক অজিতকুমার গুহকে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘ভাষাসৈনিক সম্মাননা পদক’ ও তমদ্দুন মজলিস ‘মাতৃভাষা পদক-২০০৪’-এ ভূষিত করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে কোনো পদক বা সম্মাননা দেওয়া হয়নি। অথচ এ দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তা অতুলনীয়।
ইতিপূর্বে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রামসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী অনেক সম্মানীয় ব্যক্তিকে জীবদ্দশায় যথাযথ সম্মান দেওয়া না হলেও মৃত্যুর পর তাঁদের সম্মান দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকার এই মহান সাধককে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করলে ভাষা আন্দোলন তথা এ দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তার একটি স্বীকৃতি মিলবে।
এ হাসান ইমাম মজুমদার
উপাধ্যক্ষ, কুমিল্লা অজিতকুমার গুহ মহাবিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.