জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির প্রত্যাশা by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

হিন্দুস্তান-পাকিস্তান বিভাজনে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির। তাদের ওপর জাতীয়তাবাদীদের নিপীড়নে কোনো কার্পণ্য ঘটেনি। পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্টদের কেউ কেউ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।


অধিকাংশকেই চলে যেতে হয়েছে আত্মগোপনে কিংবা স্থান পেয়েছেন কারাগারে। নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠা কঠিন ছিল। কিন্তু পার্টি আবারও যে ভুলটা করল সেটা হলো পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে শোষণ চলছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিগত সমস্যার মীমাংসাকে প্রধান প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা না করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাটিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে পার্টি যদি এগিয়ে যেত, তাহলে বাংলাদেশ হয়তো বামপন্থীদের নেতৃত্বে স্বাধীন হতো এবং পুঁজিবাদের যে দৌরাত্ম্য স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে, সেটা এতটা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পেত না, সমাজ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি এসেছে বামপন্থী তরুণদের কাছ থেকেই, এই আন্দোলনের পর সরকার যখন প্রাদেশিক পর্যায়ে নির্বাচন দিল, তখন লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্টের যে আওয়াজ কমিউনিস্ট পার্টি তোলে, সেটা সেই ব্রিটিশ আমলের কংগ্রেস-লীগ এক হওয়ার আওয়াজের মতোই ভ্রান্তির দোষে দুষ্ট ছিল। যুক্তফ্রন্ট কার সঙ্গে কার? হক সাহেবের তো কোনো দল ছিল না। তিনি তড়িঘড়ি একটা দল খাড়া করলেন, নেজামে ইসলাম পার্টির নামে একেবারেই নামসর্বস্ব একটি দলকে সঙ্গে নিলেন এবং তাদের চাপে কমিউনিস্ট পার্টিকে যুক্তফ্রন্ট থেকে বাদ দেওয়া হলো। প্রয়োজন ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের নিয়ে একটি জোট গঠন করা। তাতেও মুসলিম লীগের ভরাডুবি যে ঘটত না তা নয়, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী যে গোলযোগগুলো সামরিক শাসন জারির সুযোগ করে দিয়েছিল, তা হয়তো এড়ানো যেত। এটা একটা অনুমান বটে, কিন্তু পেছনে ফিরে মনে হয়, হক-ভাসানী যুক্তফ্রন্টের দাবি অন্তত কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত ছিল না।
এটা সত্য যে পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার দাবি বামপন্থীদেরই একাংশ তুলেছিলেন। কিন্তু তত দিনে তাঁরা নানাভাবে বিভক্ত হয়ে গেছেন। মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেই এগোবেন বলে স্থির করেছিলেন এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ যতটা এগিয়ে গিয়েছিল প্রথমে তাঁরা ততটাও এগোনো ঠিক হবে কি না- এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। পিকিংপন্থীদের অধিকাংশ চলে গিয়েছিলেন কথিত নকশালপন্থী আন্দোলনে। যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ কমিউনিস্ট কর্মীদের মুক্তিবাহিনীতে নিতে সম্মত হয়নি। এ বিষয়ে ভারত সরকারেরও সম্মতি ছিল। কেননা সে সরকার তখন পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট উগ্রপন্থীদের তো বটেই এমনকি আমাদের বামপন্থীদেরও দমননীতির আওতায় নিয়ে আসতে ব্যস্ত ছিল। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও ভারতের কংগ্রেস উভয়েরই উদ্বেগ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়তো বা একটি নতুন ভিয়েতনাম সৃষ্টি করে ফেলবে। পুঁজিবাদী বিশ্ব যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে সেটাও ওই আকাঙ্ক্ষা থেকেই যে যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত বামপন্থীদের হাতে চলে যাবে। যুদ্ধের মীমাংসাটা যে এত দ্রুত ঘটল তার পেছনেও সমাজতন্ত্রের ভীতি যে কাজ করেছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যে মুজিববাহিনী গঠন করা হয়েছিল সেটা বামপন্থীদের দমন করার উদ্দেশ্যেই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সমাজতন্ত্রীদের দায়িত্ব ছিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় অধীর মানুষকে সমাজ বিপ্লবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাকে বলি, সেটি তো আসলে এই সমাজ বিপ্লবীদেরই স্বপ্ন। কিন্তু সে কাজটি তাঁরা করতে পারলেন না। একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত তাঁদের হাতছাড়া হয়ে গেল। ১৯৫২ সালে তাঁরা যেভাবে পিছিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৭১-এর শেষে আবার অনেকটা সেভাবেই পিছিয়ে গেলেন। পিকিংপন্থীরা তখন ছত্রভঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধে তাঁরাও অংশ নিয়েছেন, কিন্তু সে অংশগ্রহণ স্বীকৃতি পায়নি। স্বাধীনতার পর তাঁরা কেবল বিভক্তই ছিলেন না, তাঁদের পক্ষে আত্মপ্রকাশ করাটাও সম্ভব ছিল না। সমাজতন্ত্রের জন্য ভরসার জায়গাটা ছিল মস্কোপন্থী বলে কথিত কমিউনিস্টরাই। তাঁরা ছিলেন খুব বড় দল। তাঁদের সঙ্গে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন ছিল। সমাজ বিপ্লবের সংগ্রামটাকে তাঁরাই পারতেন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু তাঁরা সেটা করলেন না। জাতীয়বাদী আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁরা সমাজ বিপ্লবকে সম্ভব করতে পারবেন বলে আশা করলেন। এবং সে পথেই তাঁদের রাজনীতি অগ্রসর হলো।
ওদিকে আওয়ামী লীগের একাংশ, যাঁরা ছিলেন তরুণ, তাঁরা দেখতে পেলেন যে মূল সংগঠনে তাঁদের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। তাই তাঁরা ঠিক করলেন যে পাল্টা একটা রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহ তৈরি করবেন। উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করা, যাতে মূল দলে তাঁদের জন্য সম্মানজনক স্থানের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁরা নতুন দল গড়তে চাইলেন। তাঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন, স্বাধীনতার পর পুরনো আওয়াজে কুলাবে না, নতুন আওয়াজের প্রয়োজন হবে; জনগণ কী চান, সেটাও তাঁদের অজানা ছিল না। তাই তাঁরা ধ্বনি তুললেন সমাজতন্ত্রের, কেবল সমাজতন্ত্রের নয়, একেবারে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের। মানুষ সাড়া দিল। কিন্তু এই নতুন বিপ্লবীরা তো সমাজতন্ত্র চাননি। তাঁরাও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন, নেতৃত্বটা এসেছিল সেই মুজিববাহিনীর একাংশ থেকেই, দলের নামও তাঁরা দিয়েছিলেন 'জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল'। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদীই রইলেন, সমাজতান্ত্রিক নাম নিয়েও। তাঁরা যে বেশি দূর এগোতে পারবেন না, সেটা তো জানাই ছিল। কেননা জনগণ যে বিপ্লব চাইছিল তাঁরা তো তার জন্য কাজ করছিলেন না; লক্ষ্যটা ছিল নবলব্ধ ক্ষমতার অংশ পাওয়া।
কিন্তু স্বাধীনতার পর এই দলই সবচেয়ে জোর দিয়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে এবং সেই ধ্বনি শোনা গেছে। প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা সামনে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছে, যার আমরা সাক্ষী এবং ভুক্তভোগী। কিন্তু মূল দ্বন্দ্বটা রয়েই গেছে। সেটা শাসকশ্রেণীর সঙ্গে জনগণের। শাসকশ্রেণীর চেহারা বদলেছে, কিন্তু কাজ ও চরিত্র বদলায়নি। তারা আগেও জাতীয়তাবাদের কথা বলত, এখনো সেটাই বলে। কিন্তু জনগণ চান মুক্তি, যার জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লবের। সেই প্রত্যাশা পূরণের ওপরই আমাদের সমষ্টিগত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, এমেরিটাস অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.