ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল- ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম by নজরুল ইসলাম

কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহূত একটি হেপারিন ইনজেকশনের বাজারদর ২৫০ টাকা। ওষুধটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিনেছে দুই হাজার ৯০ টাকায়। এ রকম প্রায় ৩০ কোটি টাকার ওষুধ ও চিকিৎসার উপকরণ (মেডিসিন অ্যান্ড সার্জিক্যাল রিকুইজিট—এমএসআর) কেনায় দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে সরকারের স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর।


শুধু বেশি দামে কেনাই নয়, বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য ভুয়া চাহিদাপত্র দেখিয়ে ভান্ডার থেকে ওষুধ পাচার করার ঘটনাও নিরীক্ষায় ধরা পড়েছে। এ-সংক্রান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, এই দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। দুদকের তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে দুদকের মামলাকে অজুহাত দেখিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়াটা কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে গণ খাতে সরকারি ক্রয়নীতি (পিপিআর) লঙ্ঘন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনা দরপত্রে ‘কোটেশনের’ মাধ্যমে কিডনি (নেফ্রোলজি) বিভাগের রোগীদের ব্যবহারের জন্য ২৫০ টাকা মূল্যের একেকটি হেপারিন ইনজেকশন কিনেছে দুই হাজার ৯০ টাকায়। মেসার্স এমএম এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে তারা পাঁচ হাজার ৪৯৭টি ইনজেকশন কিনেছে। এতে এক কোটি এক লাখ ১৪ হাজার ৪৮০ টাকা সরকারের ব্যয় হয়েছে।
নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসে, ২০০৭-০৮ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত হাসপাতালের সাতটি ওয়ার্ডে এক হাজার ৩৬২ বোতল হেক্সিটেন ক্রিমের চাহিদা দেখানো হয়। একই সময়ে ভান্ডার থেকে হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ডে ৪০১টি ব্রেন সার্কিটের (অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে অবেদন করতে ব্যবহূত হয়) চাহিদা দেখানো হয়। কিন্তু এসব ওষুধ ওয়ার্ডে সরবরাহ করা হয়নি। কারচুপির মাধ্যমে হাসপাতালের ভান্ডার (স্টোর) থেকে এসব ওষুধ সরিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়।
৮৫ বছরের চাহিদা, একসঙ্গে ক্রয়: নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বছরে ৫০০টি অ্যামোক্সাসিলিন ইনজেকশন ও ২৩৬টি স্ক্যাবি ক্রিম ব্যবহূত হয়। কিন্তু ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৯ হাজার ৫০০টি অ্যামোক্সাসিলিন ইনজেকশন ও ২০ হাজারটি স্ক্যাবি ক্রিম (৮৫ শতাংশ) কেনা হয়। বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী, এ দুটি ওষুধ ব্যবহার করে শেষ করতে যথাক্রমে ৩৯ ও ৮৫ বছর সময় লাগবে। কিন্তু তত দিন পর্যন্ত এসব ওষুধের কার্যকারিতা থাকবে না।
আবার চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টাকায় দুই হাজার পিস ফোম মেট্রেস কেনা হয়। কিন্তু ২০০৯ সালের ৭ জুলাই থেকে ২০১০ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় বছরে এক হাজার ৬৫২টি ফোম মেট্রেস বিতরণ করা হয়। ওই সময় স্টোরে আরও এক হাজার ৫৩টি ফোম মেট্রেস মজুত ছিল, যা দিয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরও চলার কথা।
নিয়ম লঙ্ঘন: গণ খাতে ক্রয়নীতি (পিপিআর) অনুযায়ী, পাঁচ লাখ টাকার ওপরে সামগ্রী কিনতে হলে ন্যূনতম একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনা দরপত্রে ১৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩৬২ টাকার ওষুধসহ অন্যান্য সামগ্রী কিনেছে ২০০৯-১০ অর্থবছরে। ১৩টি কার্যাদেশের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব সামগ্রী কেনা হয়।
আবার ওষুধ ও চিকিৎসার উপকরণ ক্রয়ে বাজেট বরাদ্দ না থাকলেও ভবিষ্যতে বরাদ্দ পাওয়া যাবে, এ আশায় নিয়ম লঙ্ঘন করে ১০ কোটি আট লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়ার ঘটনাও আছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে নিয়মিত, অতিরিক্তসহ ওষুধ ও চিকিৎসার উপকরণ খাতে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এই বরাদ্দ থেকে আট কোটি সাড়ে ৮৭ লাখ টাকার ওষুধ কেনার ব্যাপারে সরকারি আদেশ আছে। নিয়ম অনুযায়ী এই টাকার ৭০ শতাংশ, অর্থাৎ ছয় কোটি ২১ লাখ টাকার ওষুধ সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি (ইডিসিএল) থেকে কেনার কথা। কিন্তু সেখান থেকে কেনা হয়েছে দুই কোটি ৭২ লাখ টাকার ওষুধ। নিয়ম ভেঙে এই কেনাকাটায় সরকারের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়।
মামলার অজুহাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না: ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এসব পণ্য কেনার কমিটিতে ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) বজলে কাদের, উপপরিচালক কাজী এনামুল কবির, মো. ফয়জুল্লাহ ও বর্তমান জ্যেষ্ঠ ভান্ডার কর্মকর্তা মশিউর রহমান।
মশিউর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। হাসপাতালের কেনাকাটা কমিটির সদস্য হিসেবে কাগজপত্রে সই থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। একই দাবি করেছেন বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী এনামুল কবিরও।
প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে দুদক পৌনে সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত বছর উল্লিখিত কর্মকর্তাসহ মোট ৭৯ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা করেছে। আর দুদকের মামলা তদন্তাধীন রয়েছে, এ অজুহাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিরীক্ষায় প্রমাণিত অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, নিরীক্ষায় যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে, তাঁদের মধ্যে পরিচালকসহ কয়েকজন অবসরে গেছেন। তাই এঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। আর যাঁরা হাসপাতালে কর্মরত আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে দুদকের করা মামলাগুলোর তদন্ত খুবই ধীরগতিতে চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১০ মাস পর এসব মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের মুখপাত্র উপপরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ১০টি মামলার কোনোটিরই তদন্ত শেষ হয়নি। ভালোভাবে তদন্ত করা হচ্ছে বিধায় সময় লাগছে বলে দাবি করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.