এক ছিঁচকে চোরের গল্প by তানজিম আল ইসলাম

গুলশান থানা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ছুঁই-ছুঁই। একটি মামলা-সংক্রান্ত খোঁজ নিতে থানায় বসে আছি। সাধারণত অভিজাত এলাকা বলে উচ্চবিত্ত লোকদেরই আসতে দেখলাম সেদিন। যাঁরা ওই সময়ে এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে এসেছেন।


এক অফিসের পিয়নকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দুই দিন ধরে। অফিস থেকে অনেক টাকাও গায়েব। অফিসের বড় কর্মকর্তা এসেছেন থানাকে অবহিত করতে। পাশের আসনে বসা একজন তরুণী। তিনি বারবার একজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম ধরে খুঁজছিলেন। ওই কর্মকর্তা তখন ছিলেন না। খুব অস্থির লাগছিল মেয়েটিকে। তাঁর অস্থিরতা দেখে এক পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপা, কী সমস্যা আপনার?’ ওই মেয়েটি জানালেন, তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিলেন। তিনি মামলাটি তুলে নিতে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই কর্মকর্তা এলেন। মেয়েটি তাঁর ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলেন। এমন সময় র‌্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা এক ছেলেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে থানায় নিয়ে এলেন। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে এজাহার লিখতে বললেন। ছেলেটি র‌্যাব কর্মকর্তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করছেন পুলিশ কর্মকর্তা। অস্পষ্ট উচ্চারণ ছেলেটির। ভীতু ভীতু চেহারা। পরনে ময়লা শার্ট, গায়ের রং কালো বর্ণের আর শুষ্ক চুল। ছেলেটি গাড়ির কাচ আর পার্টস চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। ছেলেটির নামের আদ্যক্ষর ‘ম’। বয়স কত জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘জানি না।’ পুলিশ তাও লিখল ১৬ বছর। বাস্তবে ১৬ বছর হবে না হয়তো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ১২-১৩ বছরের বেশি নয়। হাত দুটি বাঁধা। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছেলেটির পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তার সঙ্গে শুরু হয় কথোপকথন—
: কত দিন হলো তুমি চুরিতে নেমেছ?
: পাঁচ দিন হইল।
: তোমাদের তো নিশ্চয়ই কোনো টিম আছে? কতজন আছ টিমে? সবার নাম-ঠিকানা কি বলেছ র‌্যাবকে?
: আমগো টিমে আছে ছয়জন। সবার নাম-ঠিকানাই দিছি পুলিশের কাছে।
: আগে কি এই কাজ করতা?
: না, আগে দোকানে চুরি করতাম। চুরি করতে গিয়া একবার ধরা খাইছিলাম, মাইর খাইছিলাম।
: তাও চুরি করতে গেছ কেন?
: পেটের ধান্ধায়।
: তোমার বাপ-মা কই থাকে?
: বাপ-মায়ের খবর জানি না। জন্মের পরই ইস্টিশনে ইস্টিশনে ঘুরছি, যা পাই খাইছি, বস্তিতে থাকছি।
এ সময় পাশ থেকে পুলিশের এক সদস্য বলে উঠলেন, ‘এ ছেলেপেলেদের বাপ-মায়ের ঠিক নাই। অবৈধ সন্তান জন্মায়ে ছেড়ে দিছে।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে চুরি করো গাড়ির সরঞ্জাম? ছেলেটি বর্ণনা দিতে থাকল। কথা শুনেই বোঝা গেল, তার এই চুরিকর্মের অভিজ্ঞতা হয়তো বেশি দিনের নয়। তবু এরা দলনেতার হুকুমেই চলে। বিনিময়ে দলনেতাই এদের খাওয়াদাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে কি র‌্যাব মেরেছে?
: হ মারছে, জোরে কয়েকটা লাথি দিছে।
: তুমি কি জানো, তোমারে কোর্টে পাঠানো হবে, জেলে পাঠানো হবে?
ছেলেটির চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। নিচের দিকে তাকিয়ে অবুঝের মতো চুপ করে গেল। এ সময় পুলিশের এক সদস্য বলে উঠলেন, ‘উকিল ধরতে টাকা লাগে। তোর লিডার কি টাকা দিব তোরে? তোর জামিন তো হবে না।’
ছেলেটি কোনো উত্তর দেয় না। একজন বলল, ‘এখানে উকিল আছে। ক তোরে জামিন করাইতে। টাকা দিবার পারবি?’
আমার দিকে তাকিয়ে আবার চুপ হয়ে গেল ছেলেটি। একজন কনস্টেবলকে ডাকলেন পুলিশ কর্মকর্তা। বললেন, ‘ছেলেটাকে হাজতে নাও।’ ছেলেটিকে হাজতে নেওয়া হলো। আমি বললাম, কী মামলা দেওয়া হলো ছেলেটির বিরুদ্ধে। চুরি আর ছিনতাইয়ের অভিযোগ।
বললাম, সে তো ছিনতাই করেনি। শুধু চুরির অভিযোগ দিলেই তো হয়। পুলিশ সদস্য বললেন, ‘দেখা যাবে।’ পরদিন সকালেই আদালতে চালান করা হবে ছেলেটিকে। ভাবতে লাগলাম, ছেলেটি শিশু। বর্তমান আইনে ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। আদালতে শিশুটিকে জেলে না নিয়ে কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য আবেদন করা হবে তো? মা-বাবার পরিচয়হীন একটি এতিম ছেলে দারিদ্র্যের জন্য, সঙ্গ দোষে এদিক-ওদিক ঠোকর খেতে খেতে হয়তো এ পেশায় এসেছে। তারও তো সুস্থ-সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার আছে...।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.