ভোলা ও হাতিয়ায় ত্রাণের জন্য হাহাকার-ঝড়ের পূর্বাভাসে গাফিলতি তদন্তে কমিটি গঠন

উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্রুটি বা গাফিলতির অভিযোগ তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার। এরই মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছেন ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা (সিগন্যাল) প্রচারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের গাফিলতি ছিল।


গত বৃহস্পতিবার ভোরে উপকূলীয় কয়েকটি জেলায় আকস্মিক ঝড়ের আঘাতে সর্বশেষ পাওয়া খবর পর্যন্ত ৩৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষ ঝড়ের বিপদের মাত্রাটি ঠিকভাবে আঁচ করতে ব্যর্থ হয় বলে মাত্র ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ কারণে তারা লোকজনকে সতর্কও করেনি সময়মতো। ঝড়ের পর এবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ না পৌঁছানোর এবং সহায়তা নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল শনিবার সরকার এক তথ্য বিবরণীতে জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াজেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় মৌসুমি নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট ঝড়ের সময় আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদানের ঘটনা তদন্তে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (স্পারসো) ও রাইমসের একজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে গতকাল নোয়াখালীর হাতিয়া ও ভোলার মনপুরা উপজেলা ঘুরে দেখা যায় ত্রাণের জন্য হাজার হাজার মানুষের অধীর প্রতীক্ষার দৃশ্য। মনপুরায় বরাদ্দ করা চাল এখনো পৌঁছেনি। সরকারি বরাদ্দের পাঁচ লাখ টাকা শুক্রবারই শেষ হয়ে গেছে। কে টাকা নিয়েছে, কাকে দেওয়া হয়েছে- এ ধরনের কোনো তালিকা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানকার প্রশাসনের কাছে ছিল না। অভিযোগ উঠেছে, এ ত্রাণ সরকারি দলের নেতাদের পছন্দের লোকদের মধ্যেই বিতরণ করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভোররাতে ঝড়ের পর বরাদ্দ করা ত্রাণ গতকাল থেকে বিতরণের কথা থাকলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তা সেখানে গিয়ে পৌঁছেনি। দুর্গতদের অভিযোগ, তিন ইউনিয়নের আওয়ামী লীগদলীয় চেয়ারম্যানরা তাঁদের পছন্দের লোকদের মধ্যে ত্রাণের চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করছেন।
মন্ত্রীর স্বীকার : গতকাল যোগাযোগমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হাতিয়া এলাকা পরিদর্শনকালে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কবার্তা প্রচারে আবহাওয়া অধিদপ্তরের গাফিলতির বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে প্রতিকারের উপায় নিয়েও কথা হয়েছে। কারো উদাসীনতা কিংবা গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওবায়দুল কাদের গতকাল তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনকালে দুটি স্থানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে এ কথা বলেন। মন্ত্রী জানান, শুক্রবার রাতে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভা হলেও প্রধানমন্ত্রী নিজে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
ওবায়দুল কাদের ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বলেন, 'ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মানুষ শেখে। দুর্যোগকালে ক্ষয়ক্ষতি যতটা কমানো যায় সেই পর্যায়ে সরকারের উচ্চাসন থেকে প্রতিকারের সিদ্ধান্ত আছে। নিজেদের (দুর্গত মানুষ) একা ভাববেন না- সরকার আছে, আমি আছি আপনাদের পাশে। ইতিমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে।'
হাতিয়ায় ত্রাণ নেই : যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল হাতিয়ায় তাঁর নির্বাচনী এলাকা ও কবিরহাটে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে নগদ টাকা ও খয়রাতি চাল বিতরণ করেছেন। তবে এ এলাকার বাইরে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে গতকাল বিকেল পর্যন্ত পৌঁছেনি সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থার ত্রাণ। এদিকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে বিভিন্নভাবে কূলে উঠে এলেও গতকাল পর্যন্ত সাতজনের হদিস পাওয়া যায়নি।
হাতিয়ায় সরকারিভাবে ৫০ টন চাল, নগদ পাঁচ লাখ টাকা ও ১০৬ বান্ডিল ঢেউটিন বৃহস্পতিবারে বরাদ্দ হলেও তা দুর্গতদের হাতে পৌঁছেনি। চর ঈশ্বর ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার জেলেপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মধুবালা দাস জানান, ঝড়ে তাঁদের খড়ের ঘর বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি পাশে তাঁর এক আত্মীয়র বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। গত তিন দিনেও তিনি চুলায় আগুন জ্বালাতে পারেননি খাদ্যের অভাবে। পার্শ্ববর্তী লোকজনের দেওয়া খাবার খেয়ে চার সন্তান নিয়ে তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
সুখচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন জানান, ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গতকাল বিকেল পর্যন্ত তিনি কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ পরিবারগুলো দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। তিনি বলেন, হাতিয়ার প্রতিটি ইউনিয়নে চার টন করে চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ রবিবার তা বিলি করতে পারবেন। এ ছাড়া সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিলি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চরকিং ইউপি চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহাম্মেদ জানান, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় সরকারি চাল বিতরণ করা যায়নি। তবে তা আজ বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার দিয়েছে। সেগুলোও আজ পুরো উপজেলায় বিতরণ করা হবে। মূলত রাস্তাঘাট খারাপ থাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা যায়নি। নিঝুম দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন জানান, ত্রাণ না আসায় তিনি বিলি করতে পারেননি।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহিদুর রহমান বলেন, 'আমাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তবে তা বিলি করা গতকাল পর্যন্ত সম্ভব হয়নি রাস্তাঘাট ভালো না থাকায়।' তিনি আশা করছেন আজ ত্রাণ বিলি করা সম্ভব হবে।
স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন শতাধিক জেলের নিখোঁজ হওয়ার কথা বললেও গতকাল পর্যন্ত মাত্র সাতজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সুখচর ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন। তবে হাতিয়া থানার ওসি মোক্তার হোসেন জানান, নিখোঁজ হওয়া জেলেরা সবাই ফিরে এসেছেন। তাঁর কাছে মাত্র দুজনের পরিবার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছে। এদিকে ঝড়ের তিন দিন পর আজ থেকে আবার জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে পাড়ি জমাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মনপুরায় ত্রাণ নিয়ে 'রাজনীতি' : উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলার মনপুরা উপজেলার আন্দিরপাড় গ্রামের পঞ্চম আলীর স্ত্রী সাফিয়া বলেন, 'ঝড়ে আমার ঘর সম্পূর্ণ ভাইঙ্গা লই গেল। আর আমরা কিচ্ছু পাই নাই। আমগো এলাকায় কেওরে এবো কিছু দেয় নো।' মৃত সেরাজুল হকের স্ত্রী সোনা বেগম বলেন, 'ঝড় হওয়ার পর থাইক্যা চাইর দিন পর্যন্ত আমার ঘরডা চডা অইয়া রইছে। টাহাও দিতাম পারি না, ঘরও খাড়া করতারি না। বিষ্টির পানিতে ঘরের তেনাতুনা পচি যায়। রাইত অইলে ঘরের বউ আর নাতি লই পাশের বাড়ির আচিগো বাড়িত থাহি। এই পর্যন্ত আমরা চাইর আনার সাহায্যও পাইনো।' একই অভিযোগ করেন আরো অনেকে।
এদিকে মনপুরার বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আলম সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, সরকারি ত্রাণের সব টাকা সরকারি দলের লোকজন লুটপাট করেছে। বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব লোকদেখানো কিছু অর্থ সাহায্য করেছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অভিযোগ অস্বীকার করে জ্যাকব কালের কণ্ঠকে বলেন, নাজিম উদ্দিন আলম সহায়-সম্বলহীন মানুষকে নিয়েও ন্যক্কারজনক রাজনীতি শুরু করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক দীপক চৌধুরী দাবি করেছেন, সরকারি সব টাকাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. অহিদুল ইসলাম গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে জানান, দক্ষিণ সাকুচিয়া ও উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের প্রত্যেক ক্ষতিগ্রস্তকে এক হাজার টাকা করে নগদ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এ অর্থ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, হাজিরহাট ইউনিয়নের জন্য এক লাখ ৬৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই ইউনিয়নে লোকসংখ্যা হচ্ছে ২৪ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা দুই হাজার ৪০০। আজ চাল দেওয়া হবে।
মনপুরায় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৫ জেলে। গতকাল এ উপজেলায় আরো চারজনের লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন আন্দিরপাড় গ্রামের আমির হোসেন (৩৫) ও একই এলাকার রাজিব (২২)। এ নিয়ে ভোলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১। এদিকে সর্বস্ব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার।
নিখোঁজ ১৫ জেলের মধ্যে মনপুরা ইউনিয়নের মনির, নুরনবী, প্রকাশ চন্দ্র দাস, হাজিরহাট ইউনিয়নের মনির, সেকান্দর, ৩ নম্বর সাকুচিয়া ইউনিয়নের বাহাউদ্দিন, দুলাল ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের বেলাল হোসেনের নাম জানা গেছে।
এদিকে ঝড়ে ডুবে যাওয়া মনপুরা-তজুমদ্দিন রুটের সি-ট্রাক এসটি রাসেল গতকাল বিকেল পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা শুক্রবার বিকেলে মনপুরায় এসেছে।
মন্ত্রীর ত্রাণ বিতরণ : যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সকাল ১১টায় ঝড়ে বিধ্বস্ত মধ্য চরকাঁকড়া উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বিদ্যালয়ের বিধ্বস্ত শ্রেণিকক্ষ দ্রুত মেরামতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নোয়াখালীর জেলা পরিষদের প্রশাসক ডা. এ বি এম জাফর উল্যাকে অনুরোধ করেন। পরে মন্ত্রী চর এলাহী বাজারে ঘূর্ণিঝড়ে নিহত চার জেলের পরিবারপ্রতি নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা এবং সরকারি তহবিল থেকে ১০ হাজার মোট ২০ হাজার টাকা করে নগদ আর্থিক সহায়তা দেন। এ সময় ঘূর্ণিজড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবারের মধ্যে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করেন তিনি। একই সময়ে রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে ৩০০ পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার, তাঁবু এবং পানির পাত্র বিতরণ করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন নোয়াখালী জেলা পরিষদের প্রশাসক ডা. এ বি এম জাফর উল্যা, জেলা প্রশাসক মো. সিরাজুল ইসলাম, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল আওয়াল প্রমুখ।
দুপুর ১২টায় মন্ত্রী কবিরহাট উপজেলার ঘূর্ণিদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে কবিরহাট পৌরসভা মিলনায়তনে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৭৫০টি পরিবারের মধ্যে ২০ কেজি করে চাল বিতরণ করেন।
এ সময় উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, 'জাতীয় নির্বাচনের আর ১২ মাস সময় রয়েছে। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে। তাই এখন থেকে জনগণের কাছে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরুন, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিন।'

No comments

Powered by Blogger.