অপরাধ- চারদিকে কেন এত নৃশংস খুনের ঘটনা? by শেখ হাফিজুর রহমান

নৃশংস খুনের সংখ্যা কি বেড়ে যাচ্ছে? মানুষের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, নৈরাজ্যিক আচরণ এবং তার মধ্যে থাকা পাশবিক হিংস্রতাই কি এ নৃশংসতার কারণ? পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়নের নলকাটা গ্রামে ৯ অক্টোবর জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তি দা দিয়ে কুপিয়ে তাঁর চার বছরের মেয়ে সুলতানা আক্তার ও আট বছরের ছেলে এমরান হোসেনকে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেন।


(প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর ২০১২) ঢাকার হাজারীবাগে প্রতিবেশী শামীম আহমেদ আইনজীবী দম্পতির ১৩ বছরের মেয়ে করবীর শ্লীলতাহানির পর তার গলায় জিআই তার পেঁচিয়ে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে এসে শামীম করবীর গলায় আঘাত করেন। এভাবে শারীরিক নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে খুন হয় ১৩ বছরের বালিকা করবী। (যায়যায়দিন, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২।) ডাকাতদের লুটপাটে বাধা দেওয়ায় তাদের ছুরিকাঘাতে নিজের বাসায় গত ২৫ আগস্ট নির্মমভাবে খুন হন বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত। গত ৬ অক্টোবর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম আহমেদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করেন তাঁরই খালাতো বোনের স্বামী হাফিজ আল আহাদ। তালিকা আর দীর্ঘ না করে প্রশ্ন রাখতে চাই, চারদিকে কেন এত নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে?
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে তিন হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার মানুষ খুন হচ্ছেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ পরিসংখ্যান থেকে এ চিত্র দেখা যাচ্ছে। ২০০৩ সালে সর্বনিম্ন তিন হাজার ৪৭১ জন খুন হয়েছেন এবং ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ চার হাজার ২১৯ জন খুন হয়েছেন। বাংলাদেশের গ্রাম, শহর ও মফস্বলে যত খুন হয়েছে, তারই বার্ষিক প্রতিবেদন এটি। অধিকাংশ খুনের পেছনে থাকে কোনো না কোনো মোটিভ বা উদ্দেশ্য, থাকে ক্রিমিনাল ইনটেনশন বা অপরাধমূলক ইচ্ছা। খুনের আবার রয়েছে স্থান, কাল, পাত্র। স্থান, কাল, পাত্রভেদে অনেক ক্ষেত্রেই খুনের ধরন যায় পাল্টে। কাউকে খুন করা হয় গুলি করে, কাউকে হত্যা করা হয় টেঁটা-বল্লম দিয়ে আঘাত করে, কোনো খুনের জন্য আবার প্রয়োগ করা হয় বিষ, কাউকে আবার খুন করা হয় দা, বঁটি বা ছুরি-জাতীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে। কখনো কখনো এমন হয় যে খুন করার পর মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে তা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয় বা ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে।
মানুষ কেন খুন করে? পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে কি কোনোভাবে প্রতিরোধ করা যায়? যাঁরা অপরাধ, অপরাধী ও অপরাধবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের ভাষ্যমতে, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন। ব্যক্তিগত রেষারেষি, প্রণয়ঘটিত জটিলতা, সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব, ব্যবসায়িক বিরোধ বা অন্য কোনো কারণে যদি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অন্য একজন ব্যক্তিকে খুন করার ব্যাপারে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়, তা হলে সেই খুন আটকানোর পথ থাকে না। কেননা, যারা খুন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে, প্রহরীকে হাত করে বা প্রহরীর নজরদারি এড়িয়ে সবচেয়ে কার্যকর কৌশলটিই বেছে নেয় এবং ওই কৌশলের মাধ্যমেই তারা শেষ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। তবে যেসব কারণে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অন্য একজন ব্যক্তিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেসব কারণ দূর করা গেলে বা কারণগুলোর তীব্রতাকে কমিয়ে আনা গেলে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে আসতে পারে। অন্যভাবেও খুনসহ সব ধরনের অপরাধের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়। সেটি হচ্ছে, আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং অপরাধীদের সুনিশ্চিত শাস্তির ব্যবস্থা করে। কেননা, আইনের প্রয়োগ এবং অপরাধের শাস্তি যখন নিশ্চিত হবে, সেটি সম্ভাব্য অপরাধীর মধ্যে ভয় এবং আতঙ্কের কারণ হবে, তারা তখন ভাববে যে অপরাধ করলে তার জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। এই ভয় ও আতঙ্ক তখন তাদের অপরাধ সংঘটিত করা থেকে নিবৃত্ত করবে। বাংলাদেশে আমরা এমনও ঘটনা দেখেছি যে হত্যা মামলার আসামি জামিন নিয়ে জামিনে থাকা অবস্থায় আরও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যা মামলার আসামিকে জামিন দেওয়ার ব্যাপারে আদালত এবং পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস (এবং অবশ্যই অপরাধ মামলার আইনজীবী) যদি সব সময় সতর্ক থাকেন, তা হলে হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কিছু অপরাধ এড়ানো সম্ভব হয়। আরেকটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। ২০০৬ সালে সেনাবাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন যখন দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য এবং কার্যকর অভিযান শুরু করল, তখন ঢাকার রাজপথে বিলাসবহুল গাড়ির অনেক মালিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি বা তাঁরা তাঁদের কোটি টাকার গাড়ি ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে।
যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম আবার সেই প্রশ্নে ফিরে আসি। নৃশংস খুনের সংখ্যা কি বেড়ে যাচ্ছে? নাকি কিছু মানুষ নানা কারণে ও পরিস্থিতিতে অন্য একজন মানুষকে দা, ছুরি বা বঁটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে আনন্দ পায়? কী ধরনের পাশবিক নিষ্ঠুরতা বা পৈশাচিক মানসিকতা নৃশংস সব খুনের পেছনে কাজ করে? ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুনিরা যখন কোনো ব্যক্তিকে আঘাত করে, রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত করে তার শরীর, তাদের মনে কি তখন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না? কেন আজ চারদিকে খুনের এত ছড়াছড়ি? এটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, যে সামাজিক মূল্যবোধগুলো মানুষকে অপরাধ ও বিচ্যুতি থেকে দূরে রাখে, সেই মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। দ্রব্যমূল্যের চাপে জেরবার হয়ে, বাসাভাড়ার চাপে অতিষ্ঠ হয়ে, স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সহিংসতার ছড়াছড়ি দেখে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সর্বত্র বিস্তৃত দুর্নীতি দেখে দেখে মানুষ এখন অধৈর্য, অসহিষ্ণু ও অস্থির। অসহিষ্ণু ও অস্থির এসব মানুষ যেকোনো সময় অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে অথবা বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন থেকে। সমাজের যে প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় থাকলে সমাজের ভারসাম্য রাখা সহজ হয়, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। পারিবারিক বন্ধন, নৈতিক শিক্ষা, ধর্ম, সামাজিক মূল্যবোধ—কোনো কিছুই যেন কাজ করছে না। সে জন্য চারদিকে নানা ধরন ও মাত্রার নানা অস্থিরতা, বিচ্যুতি ও অপরাধের ছড়াছড়ি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া এবং অপরাধীদের শাস্তি না পাওয়া।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ অপরাধ সংঘটিত হয়, তার মধ্যে শতকরা মাত্র ১০ থেকে ২০ ভাগ মামলায় অপরাধীর শাস্তি হয়। বাকি শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মামলায় অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবার, শিক্ষা, ধর্ম ও সামাজিক মূল্যবোধের যেমন সক্রিয়তা দরকার, তেমনি দরকার আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। নইলে ক্রমেই সহিংস ও নৈরাজ্যিক হয়ে ওঠা বাংলাদেশকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
শেখ হাফিজুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ও অপরাধবিজ্ঞান গবেষক।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.