মেঘনার তীরে স্বজনদের প্রতীক্ষা- লাশ দেখলেই বুকফাটা কান্না by নেয়ামতউল্যাহ

ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ শতাধিক জেলে তিন দিন পরও ফিরে আসেননি। তাঁদের ফিরে আসার পথ চেয়ে মেঘনার দিকে ব্যাকুল তাকিয়ে আছেন স্বজনেরা। গতকাল শনিবার ভোর থেকেই ভোলার মনপুরা উপজেলায় মেঘনার তীরে দেখা যায় মানুষের ভিড়।


কখনো কখনো ভেসে আসছে লাশ। আর ওই লাশ দেখতে ছুটে যান অনেকে। শনাক্ত করার পর স্বজনেরা বুকফাটা আর্তনাদ করেন। অন্যরা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যান নদীর কিনারে। আবারও প্রতীক্ষা করেন তাঁরা।
মনপুরা উপজেলায় গতকাল সকালে হাজীরহাট স্লুইসগেট ও পুরাতন থানা এলাকার কাছে মেঘনায় দুটি লাশ দেখা যায়। মুহূর্তের মধ্যে ওই লাশ দুটি ঘিরে জড়ো হন অনেক মানুষ। এর কিছুক্ষণ পর উত্তর সাকুচিয়া জনতা বাজারের কাছে মেঘনায় পাওয়া যায় আরও দুটি লাশ। বিকেলে ভেসে আসে আরেকটি লাশ। গত বুধবার রাতের ঝড়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত মনপুরায় আটজনের লাশ পাওয়া গেছে।
নোয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বুধবারের আকস্মিক ঝড়ে ২১ জনের মৃত্যু হয়। নিখোঁজ হয় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। গতকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭। ঝড়ে সাড়ে ১৩ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
গতকাল ভোরে মনপুরা ইউনিয়নের আন্দিরপাড়ে কালু মাঝি নামের (৫৬) এক জেলের সঙ্গে কথা হয়। তাঁর ছেলে রাজীবের (২২) জন্য প্রতীক্ষা করছেন তিনি। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী, নিজে জীবন বাজি রেখে নদীতে মাছ ধরেছেন। কিন্তু তাঁর ছেলে রাজীবকে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় পাঠাননি। ব্যবসায় বসিয়েছিলেন। ঝড়ের আগের রাতে শখের বশে মাছ ধরতে যান রাজীব। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কালু বলেন, ‘আঁর বাজান আমারে কামাই কইর‌্যা খাওয়াইত। আমগো বুড়াবুড়িগোরে ভালা জানত। আমার হেই পোলাডাই খইত (মারা) গেছেগো। আই অহন কী করুম কনগো।’
এরপর আক্ষেপ ঝরে কালুর কণ্ঠ থেকে। তিনি বলেন, ‘দ্যাশের এত্তো জাইল্যা নিখোঁজ অইল, কিন্তুক হেই মানুষ খোঁজনের কোনো ব্যবস্থা করেনো সরকার। আমরাই ট্রলার ভাড়া কইর‌্যা কালকিনি গেছি, পাতাইল্যা গেছি; পকেটের টিয়াও শ্যাষ।’
কালু বিকেলে জানতে পারেন, উদ্ধার হওয়া লাশের একটি তাঁর ছেলে রাজীবের। আর তখন শোকে পাথর হয়ে যান তিনি।
সাগরের মোহনায় মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে সোনার চরের বেলাল আহমেদের বড় ছেলে শরীফুল ইসলাম (১৪)। ঝড়ে ডুবে যাওয়া নৌকার অন্য নয়জন জেলে ফিরেছেন। শুধু শরীফই ফিরে এল না ঘরে। ছেলে হারানোর শোকে তার মা তাছলিমা বেগম পাগলপ্রায়। বেলালের বাড়িতে পাঁচটি ঘর। ঝড়ে সব কটি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বাড়ির আশপাশের গাছগুলো ভেঙে পড়ে আছে।
সামসুল হক (৮৬) বলেন, বুধবার থেকে তাঁদের ঘরে রান্না বন্ধ। প্রতিবেশীরা কিছু খাবার দেন। নইলে না খেয়ে থাকেন। সরকার এখনো তাঁদের কোনো সহায়তা দেয়নি। স্থানীয় লোকজন বলেছেন, এই পরিবারের মতো মনপুরায় কমপক্ষে পাঁচ হাজার পরিবারের একই অবস্থা।
উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ৭০০ নৌকার প্রায় নয় হাজার জেলে বুধবারের ঝড়ের কবলে পড়েন। গতকাল পর্যন্ত অধিকাংশ জেলে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এখনো নিখোঁজ শতাধিক। এসব পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, জেলেদের উদ্ধারে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অভিযান চালায়নি।
বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন রোদ-বৃষ্টিতে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ঝড়ে গাছ ভেঙে উপজেলার সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। গাছপালা ভেঙে পড়ে পুকুরের পানি থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে।
মনপুরার আন্দিরপাড়ের মো. ইউসুফ মাঝির ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে। নদী থেকে নিয়ে গেছে দেড় লাখ টাকার নৌকা। ঘর ও নৌকা হারিয়ে ইউসুফ এখন দিশেহারা। তিনি বলেন, ‘এরুম তুয়ান জীবনে দেইনো। চোখ মেইলতাম পারি না। বাতাসে পিডি নৌকা ডুবাই নিছে। নিজে কোনো রুম বাঁচি আইছি।’
আন্দিরপাড়ে শত শত জেলে তাঁদের মাছ ধরা নৌকা-জাল-ইঞ্জিন হারিয়েছেন। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ সাকুচিয়ার জসিম মাঝি, বেলাল মাঝি, হাজীরহাটের সোনারচরের অর্চনা রানী দাস, স্বপন চন্দ্র দাস, হরেন্দ্রনাথ বাড়ির স্বপন নাথ, ইউসুফসহ অনেকে অর্থাভাবে ঘর তুলতে পারছেন না। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের।
ভোলার জেলা প্রশাসক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারপ্রতি এক হাজার টাকা ও ১০ কেজি করে চাল বিতরণ শুরু করেছি। কিন্তু স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা সেটি বিতরণ করতে কেন অলসতা দেখাচ্ছেন, বুঝতে পারছি না। এ জন্যই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছেন।’
নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারে প্রশাসন কিছু করেনি—এই অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা প্রশাসক বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রথম দিন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অভিযান চালিয়েছেন। পরে হয়তো তা অব্যাহত রাখেননি।
ভোলা-৪ আসনের সাংসদ আবদুল্লাহ আল ইসলাম গতকাল শনিবার ও গত শুক্রবার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলা পরিদর্শন করেছেন। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঝড়ে মনপুরায় হাজারেরও বেশি ও চরফ্যাশনে ৫০০ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ফলে এই এলাকার মানুষকে চরম দুর্ভোগে দিন কাটাতে হচ্ছে।
সাংসদ বলেন, ‘গত দুই দিনে আমি নিজ উদ্যোগে মনপুরা এবং চরফ্যাশনের ঢালচর ও চরপাতিলায় ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ১০ লাখ টাকা বিতরণ করি। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে আরও ১০ লাখ টাকা ও ৫০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।’

No comments

Powered by Blogger.