ডি-৮ জোট- বাণিজ্য-সম্ভাবনা কাজে লাগান by সমীরণ রায়

বিশ্বে বর্তমানে ৩১৯টি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্য জোট আছে। এর একটি হচ্ছে, ডেভেলপিং এইট বা ডি-৮। এসব বাণিজ্য জোটের লক্ষ্য হচ্ছে, সদস্যদেশগুলোর সম্পদ ও সামর্থ্য নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান এবং সমন্বিত উৎপাদন ও বাণিজ্য-কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে জোটের সবার আর্থসামাজিক উন্নতি নিশ্চিত করা।


এ লক্ষ্য অর্জনে ইউরোপের ২৭টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন; যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোকে নিয়ে গঠিত উত্তর আমেরিকা মুক্তবাণিজ্য জোট ন্যাফটা; দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশ নিয়ে সৃষ্ট আসিয়ান মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল; লাতিন আমেরিকার উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও ভেনেজুয়েলা নিয়ে গঠিত ‘মারকোসোর’ বাণিজ্য জোট; আফ্রিকার দেশগুলো নিয়ে গঠিত আফ্রিকান ইকোনমিক কমিউনিটিসহ কয়েকটি বাণিজ্য জোট অত্যন্ত সফল। অপর দিকে ডি-৮সহ প্রায় ৩০০টি বাণিজ্য জোটই লক্ষ্য অর্জনে অনেক পিছিয়ে আছে। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো ডি-৮-এর শিল্প সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন।
সদস্যদেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার লক্ষ্য নিয়ে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ডি-৮-এর জন্ম হয় ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের আটটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এ জোটের সদস্য। অপর সাতটি দেশ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ইরান, মিসর, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়া। আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশগুলো যথাক্রমে বিশ্বের ১৫, ১৬, ১৭, ২৬, ২৭, ২৯ ও ৩০তম বড় অর্থনীতি। বাংলাদেশ বিশ্বের ৪২তম অর্থনীতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এ জোটের পরিধি। বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়নশীল মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান দৃঢ় করা, বাণিজ্য সম্পর্ক বহুমুখীকরণ ও নতুন সুযোগ সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং জীবনমানের উন্নয়ন এ জোটের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শিল্প সহযোগিতা, পরিবহন এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ—এ পাঁচটিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাতগুলোতে সহযোগিতার
ক্ষেত্র চিহ্নিত করা এবং সেগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যই সদস্যরাষ্ট্রগুলো খাতভিত্তিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সিদ্ধান্তগুলো শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত হওয়ার পর বাস্তবায়ন শুরু হয়।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পিপিপির ভিত্তিতে ২০১০ সালে দেশগুলোর মোট জিডিপি ছিল পাঁচ হাজার আট বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দেশগুলোর মোট বাণিজ্য হয়েছে এক হাজার ২০০ বিলিয়ন ডলার, বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৪ শতাংশ। দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৯৫ কোটি। বিশ্বের মোট মুসলিম জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশের আবাস এ আটটি দেশে। জনশক্তি ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বিচারে ডি-৮ বিশ্বের একটি অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট হতে পারে। কিন্তু এখনো হয়নি। প্রতি দুই বছরে একবার সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সমন্বয়ে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সে অনুযায়ী সপ্তম শীর্ষ সম্মেলন ২০১০ সালে নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। অষ্টম শীর্ষ সম্মেলন আগামী মাসে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হবে। সপ্তম শীর্ষ সম্মেলন ঘোষণায় দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বৃহৎ দেশগুলোর বাজারে পণ্য প্রবেশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া জোটের উদার বিনিয়োগ নীতি, বিশাল জনশক্তি ও কম ব্যয়ে পণ্য উৎপাদনের সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আনার আহ্বান জানানো হয়। একটি বিনিয়োগ তহবিল গঠনের কথা বলা হয়। ২৪ দফা ঘোষণায় এমন আরও উদ্যোগের কথা থাকলেও এগুলো বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত মন্থর।
আগের ছয়টি শীর্ষ সম্মেলনে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আন্তজোট বাণিজ্য মোট বাণিজ্যের ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ২০০৬ সালের পর থেকে আন্তজোট বাণিজ্য বাড়তে থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে এ জোটেও বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়ে। ২০০৬ সালে আন্তজোট বাণিজ্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০০৭-এ ৬৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০০৮-এ সর্বোচ্চ ৭৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ২০১০-এ তা ৭০ বিলিয়ন এবং ২০১১-এ ৬৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বাংলাদেশ সার্কের মতো ডি-৮-এও রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি করে। ২০১০-১১ অর্থবছরে আমদানি করেছে ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। অপর দিকে রপ্তানি করেছে ৪৬৪ মিলিয়ন ডলার। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে দেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৮ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলো থেকে আমদানি করেছে ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার এবং রপ্তানি করেছে মাত্র ৩৯১ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ৭ শতাংশ। তার পরও বাংলাদেশ ডি-৮ আন্তজোট গড় বাণিজ্যের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে ডি-৮ নেতারা ২০১৮ সালের মধ্যে আন্তজোট বাণিজ্য দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। বাস্তবে কিছুই হয়নি। তাই গত ১০ অক্টোবর শিল্পসহায়তাবিষয়ক ডি-৮ সম্মেলন উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডি-৮-এর ১৫ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর কথা বলেছেন। দেশগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিক বাণিজ্য চুক্তি হলেও তা কার্যকর হয়নি। ভিসা সহজীকরণ ও শুল্ক হ্রাসসংক্রান্ত চুক্তি কাগজেই সীমাবদ্ধ আছে। ডি-৮-এ বাংলাদেশই একমাত্র স্বল্পোন্নত দেশ। সংগতভাবেই বাংলাদেশ ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করেছে। পাশাপাশি সদস্যদেশগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেছে। জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের ওপরও বাংলাদেশ গুরুত্ব দিয়েছে।
ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। তৈরি পোশাক, ওষুধ, পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও সমুদ্রগামী জাহাজ রপ্তানিতে ভালো সামর্থ্য আছে। তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে চীনের পরই দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ। ৭২টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। পাট ও পাটজাত পণ্যে সামর্থ্যের খুব কমই ব্যবহূত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্ব শ্রমবাজারে সপ্তম জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। এই প্রতিটি খাতেই ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোতে ব্যাপক চাহিদা আছে। দেশগুলো বিশ্ববাজার থেকে এসব পণ্য ও সেবা আমদানি করছে। এসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে বেশি আমদানি করলে উভয় পক্ষই লাভবান হবে। বর্ধিত চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে দেশগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। বাংলাদেশের সস্তা শ্রম, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও পণ্য দ্রুত পরিবহনের ভালো বন্দর-সুবিধা কাজে লাগাতে পারে। এভাবে ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোর সামর্থ্য ও সম্পদ আদান-প্রদানের মাধ্যমে জোটের মধ্যে একটা উইন-উইন সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। জোটের লক্ষ্য অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারলে ডি-৮ আসিয়ানের মতো একটি গতিশীল অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য জোটের জন্য তা অনুকরণীয় হবে।
সমীরণ রায়: অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.