চরাচর-রথখোলায় দুধের আড়ত by পাভেল রহমান

ঘড়িতে তখন বিকেল ৩টা। আমরা চলেছি পুরান ঢাকার নবাবপুর রোড দিয়ে রথখোলার দিকে। উদ্দেশ্য শত বছরের পুরনো পাইকারি দুধের আড়ত দেখা। রিকশায় বসে বসে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। রথখোলার এই পাইকারি দুধের আড়তগুলো কি এখনো আছে, নাকি সময়ের বিবর্তনে এগুলোর অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে।


রথখোলায় পৌঁছে একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলেন, 'ওই যে টিনের চালওয়ালা দুটো ঘর, ওগুলোই দুধের আড়ত।' চোখ ফেরাতেই দেখি, হাইরাইজ বিল্ডিংগুলোর পাশে মাত্র দুটি দোকান নিয়ে অনেকটা জীর্ণশীর্ণভাবে এখনো টিকে আছে শত বছরের পুরনো এই দুধের আড়ত। আড়তের সামনে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন দোকানের কর্মচারীরা। জানতে চাইলাম, আড়তের বেচা-বিক্রি কখন শুরু হবে? একজন বললেন, ৫টায় আসেন। এভাবেই কথার সূত্রপাত কর্মচারীদের সঙ্গে। গল্পের মধ্যে কর্মচারীরা বলতে থাকেন, এই আড়তে প্রতিদিন ১০০-১৫০ মণ দুধ আসে। এই দুধ সন্ধ্যার পর এসে কিনে নিয়ে যায় ঢাকার বিভিন্ন মিষ্টি-দই-ছানা-মাঠার দোকানের লোকজন। এখানে দুধ কিনতে ধানমণ্ডি-গুলশান-বনানীর অনেক স্বনামধন্য দোকানের লোকজন আসেন। এই দুধ সংগ্রহ করা হয় কিভাবে জানতে চাইলে পাশ থেকে একজন বলতে শুরু করেন, 'এত দুধ তো এক জায়গা থেকে আসে না, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে। তবে বেশির ভাগ দুধ আসে ধামরাই, আবদুল্লাহপুর ও মাওয়ার আশপাশের গ্রাম থেকে। সেখান থেকে লোকজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই দুধ একসঙ্গে করে আড়তে নিয়ে আসে। আবার আবদুল্লাহপুরে কিছু খামার আছে, সেখান থেকে দুধের অনেক বড় একটা চালান আসে। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা দুধ একসঙ্গে করে ঢাকার কাস্টমারদের কাছে বিক্রি করি।' দুধের ব্যবসার কথা শুনলেই দুধে পানি মেশানোর ব্যাপারটি চলে আসে। এ বিষয়ে আড়তের কর্মচারীদের বক্তব্য, 'আমাদের এখানে দুধ সংগ্রহ থেকে বিক্রি পর্যন্ত নিজেদের লোকদের দিয়ে তদারকি করানো হয়। সেই ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখানে এই দুধের আড়তগুলো চালাচ্ছি। দুধে পানি মিশিয়ে আমাদের এত দিনের ব্যবসা ধ্বংস করব কেন?' দুধের দামের ক্ষেত্রে কোনো মূল্য নির্ধারিত নেই। দেখা যায়, বিভিন্ন উৎসবের সময় প্রতি মণ দুধ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। আবার স্বাভাবিক দিনগুলোতে প্রতি মণ দুধ বিক্রি হয় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। কথা বলতে বলতে এদিকে পাইকারি খরিদ্দারদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কর্মচারীরা। আমরাও বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছি, মন তখন অনেকটাই নস্টালজিক হয়ে উঠেছে। ভাবছি, মামার বাড়ি গিয়ে দুধ-ভাত খাওয়ার সুবর্ণ দিন এখন আর নেই। নানিও আর নাতিদের দুধ-ভাত পেট পুরে খাওয়ার জন্য ডাকেন না। এই ইট-পাথরের শহরে কোনো মা কি তাঁর সন্তানদের খাওয়াতে গিয়ে বলেন, 'আয়রে খোকন ঘরে আয়/দুধমাখা ভাত কাকে খায়'। আমাদের খোকনরা এখন টম অ্যান্ড জেরি কিংবা ডরিমন দেখে দেখে ফাস্টফুড খাওয়ায় ব্যস্ত।
পাভেল রহমান

No comments

Powered by Blogger.