বিষণ্নতা : একটি জনস্বাস্থ্য সংকট by জিল্লুর রহমান রতন

বিষণ্নতা একটি সর্বজনীন আবেগ ও অনুভূতি। জীবনে কোনোদিন কারও মন খারাপ হয়নি এ বিষয়টি প্রায় অসম্ভব। অনেক সময় আমাদের জীবনে ঘটে থাকে নানা রকমের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, অপ্রাপ্তি, হারানোর কষ্ট; যে কারণে দুঃখবোধ হয় ও হতাশা বোধ করি।


এ বিষয়টি জীবনে অনিবার্য যা মেনে নিয়ে আমাদের জীবনযাত্রার গতিপ্রকৃতি অব্যাহত রাখতে হয়। কিন্তু বিষণ্নতার কারণে যখন কারও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও কর্মদক্ষতা হ্রাস পায় তখন তাকে আর দৈনন্দিন দুঃখবোধ বলার কোনো সুযোগ নেই। আসলে তখন এটি বিষণ্নতা নামক একটি মানসিক রোগ যা জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
বিষণ্নতাকে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধির মতো অবহেলা করার যে কোনো সুযোগ নেই তা বোঝার জন্য জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। বিশ্বব্যাপী রোগের বোঝা বিষয়ক গবেষণায় (২০০৪) দেখা যায়, রোগের কারণে কর্মসময় নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে বিষণ্নতার স্থান তৃতীয় (হৃদরোগের পূর্বে) যা ২০৩০ সালে প্রথম স্থান অধিকার করবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। যদিও বিষণ্নতার কারণে মৃত্যুঝুঁকি হৃদরোগের চেয়ে কম কিন্তু এর অর্থনৈতিক ক্ষতি ব্যাপক। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর যে ১০ লাখ লোক আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করে থাকে তার বেশিরভাগ সংঘটিত হয় বিষণ্নতার কারণে। আর বিশ্বের ৩৫ কোটি লোক এবং আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি জনগণ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। এরপরও কি কারও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা, কেন বিষণ্নতা অন্যান্য অসংক্রামক ব্যাধির মতো সমান গুরুত্ব দাবি করে।
এমনিতেই বিষণ্নতা ও অন্যান্য মানসিক রোগ নিয়ে সমাজে ভ্রান্ত ধারণা এবং কুসংস্কারের অন্ত নেই। এ রকম একটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, যারা দুর্বল চিত্তের তারা বিষণ্নতায় ভোগে। অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে মন খারাপ কিংবা সবকিছুতে অনীহা এ বিষয়টিকে পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন এবং অবহেলা করেন। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মহিলাদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি বেশি ঘটে থাকে যার জন্য 'আমার মন খারাপ বা কিছু ভালো লাগছে না' এ ধরনের আবেগের বহিঃপ্রকাশকে নিন্দনীয় আচরণ হিসেবে দেখা হয়। অথচ গবেষণায় দেখা যায় মহিলাদের মধ্যে বিষণ্নতার প্রকোপ বেশি এবং পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রতি ১০ জনের একজন জীবনের যে কোনো সময় বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন যাদের অর্ধেকের বেশি আবার চিকিৎসা সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন। অথচ বিষণ্নতা একটি সহজে চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ বা মস্তিষ্কের (ব্রেইন) রোগ। ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, আর্থসামাজিক অবস্থান ও বয়সভেদে যে কেউ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। এ ব্যাপারে জনসচেতনতার অভাব ও রোগের লক্ষণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না থাকার কারণে জনগণ চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে না।
বিষণ্নতার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে বেশির ভাগ সময় মন খারাপ, হতাশ ও বিষণ্নবোধ করা এবং সবকিছুর প্রতি অনীহা ও অনাগ্রহ বোধ করা। কোনো ব্যক্তি যখন পূর্বে যেসব কাজ বা বিনোদনে আনন্দ পেত, কিন্তু বর্তমানে আর পাচ্ছে না তাহলে তার বিষণ্নতা রয়েছে কি-না তা নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় হাত-পা ও পুরো শরীর জ্বালা-পোড়া করা, সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যতীত শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা, অতিরিক্ত দুর্বল ও ক্লান্তিবোধ, ওজন কমে যাওয়া, খাবারে অরুচি, ঘুমের সমস্যা, যৌন আগ্রহ কমে যাওয়া প্রভৃতি শারীরিক উপসর্গ নিয়ে বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসকের সহায়তা চান। ব্যথাসহ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া রোগীদের ওপর এক গবেষণায় দেখা যায়, তাদের ৭২ ভাগই জানতেন না তারা বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। এ বিষয়টি আমাদের দেশের বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষত মহিলা রোগীদের জন্য বেশি প্রাসঙ্গিক। এ ছাড়াও বিষণ্নতায় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষারোপ করা এবং আত্মহত্যার চিন্তা ও প্রবণতা হতে পারে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়া ও ভুলে যাওয়া, খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কমে যাওয়া ও চুপচাপ হয়ে যাওয়া বিষণ্নতার পূর্ব লক্ষণ হিসেবে প্রকাশিত হতে পারে। আবার জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের মধ্যেও বিষণ্নতার প্রকোপ বেশি। কিছুদিন আগে বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালিত হয়েছে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। আবার অনেকে বলে থাকেন মন খারাপ হলে চাইলেই সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু বিষণ্নতা রোগে যখন মস্তিষ্কের রাসায়নিকের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয় তখন ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
বিষণ্নতার করাল গ্রাস থেকে জাতিকে মুক্ত করতে প্রয়োজন সচেতনতা।

ডা. জিল্লুর রহমান রতন :সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
mzrkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.