বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-পথের বাধা দূর করার উদ্যোগ by মোস্তাফিজুর রহমান

অক্টোবরের ৪-৫ তারিখ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির একটি প্রতিনিধি দল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে দিলি্লতে ভারত-বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেয়। প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী,


সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, রেজা আলী এমপি, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান, এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত, জাতিসংঘ-এসকাপের সাবেক পরিচালক এম রহমতউল্লাহ, সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সিপিডি এবং এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে এর আয়োজন করে। এ ধরনের সংলাপ গত কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। আমরা লক্ষ্য করছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে উন্নতি ঘটছে এবং এর পেছনে এ ধরনের বেসরকারি উদ্যোগের অবদান স্বীকৃত। এ উদ্যোগ দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন এবং বিদ্যমান সমস্যাগুলো দূর করার পথের বাধা অপসারণে সহায়ক হয়_ সেটা বিশিষ্টজনেরা স্বীকার করেন।
এবারের সংলাপে ৫টি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এক. বাণিজ্য। ভারত বাংলাদেশকে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, তা কাজে লাগানো এবং তা থেকে সর্বোত্তম ফল কীভাবে লাভ করা যায় সেটা ছিল আলোচনায়। দুই. কানেকটিভিটি_ সড়ক, রেল ও নৌপথে বৃহত্তর পরিবহন সহযোগিতা। তিন. পানি। বিশেষভাবে আলোচনায় আসে তিস্তার পানি বণ্টন। চার. দুই দেশের গণমাধ্যমের সহযোগিতা। পাঁচ. পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করা।
সংলাপের বাইরেও প্রতিনিধি দল ভারতের রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। এর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কথা। তিনি দীর্ঘদিন পররাষ্ট্র, অর্থ, প্রতিরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বরাবরই তিনি পরিচিত। সংলাপের বিষয়বস্তু তাকে আমরা অবহিত করি। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ানোর বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। আর্থ-সামাজিক বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের জন্য তিনি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। বিশেষভাবে বলেন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের রাজ্যগুলো এবং নেপাল ও ভুটানের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বাড়ানোর কথা। বাংলাদেশকে ভারত যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান করেছে, তা দ্রুত ব্যবহারের কথাও তিনি বলেন।
আমাদের আলোচনা হয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপির রাজ্যসভার নেতা অরুণ জেটলির সঙ্গে। সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় প্রভৃতি বিষয়ে তার কাছে আমাদের অবস্থান তুলে ধরি। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হলেও ভারত তা করেনি এবং এ থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টে দ্বিদলীয় সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে এবং বিজেপির দিক থেকে সেটা দেওয়া হবে। তিনি বিশেষভাবে কোয়ালিফায়েড মেজরিটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি দূর করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি কানেকটিভিটিকে সেবা খাত হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে আয় যথেষ্ট বেড়ে যাবে। তিনি দুই দেশের বন্ধুত্ব বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পানি ব্যবস্থাপনা ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ও কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের বিষয়টিও তিনি উপস্থাপন করেন।
আমাদের আরও আলোচনা হয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে। তিনি দিলি্লর সরকারি মহলে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় যেসব চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে, তা বাস্তবায়নের তদারকির দায়িত্ব রয়েছে তার ওপর। শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে আসে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট বা বিএসটিআইকে শক্তিশালী করার বিষয়টি। তিনি জানান যে, এজন্য ভারত কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে এবং আগামীতে আরও বাড়বে। ভারত বাংলাদেশকে যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের অঙ্গীকার করেছে, ইতিমধ্যে তা থেকে ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাকি ৮০ কোটি ডলার ঋণের জন্য সুদের হার ধরা হয়েছে খুব অল্প। এ ঋণ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। ছিটমহল বিনিময় ও সীমান্ত চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশনে এ বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের চেষ্টা করছে বলে তিনি জানান। তিনি মনে করেন, তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে চুক্তি না হলেও বাংলাদেশ পানিতে ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে।
নির্ধারিত বিষয়গুলোর ওপর সংলাপ এবং শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় ভারতে রফতানি বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের সরবরাহ ক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। বর্তমানে ৫০৫২টি পণ্যের মধ্যে মাত্র ২৫টি (অস্ত্র, মদ ও তামাক) বাদে বাংলাদেশ যে কোনো পণ্য ভারতে শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ঝুড়িতে বেশি পণ্য না থাকা এবং যা আছে তার পরিমাণও পর্যাপ্ত নয়। ভারতের দিক থেকে অশুল্ক বাধাও বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসে। শিবশঙ্কর মেনন সীমান্ত এলাকায় অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন এবং ভারতের দিক থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা বলেন। ভারতের বাজারের জন্য শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনায় মূল বক্তব্য আমি উপস্থাপন করি। ২০০৩ সালে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ১০ কোটি ডলার। এখন তার পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি ডলার। তারপরও বাণিজ্যে ঘাটতি রয়ে গেছে প্রচুর এবং চলতি বছরে এর পরিমাণ ৪২০ কোটি ডলারেরও বেশি। কারণ একই সময়ে ভারত থেকে আমদানিও বেড়ে চলেছে। ২০০৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৩৫ কোটি ডলার। ২০১২ সালে তা ৪৭৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশের রফতানি সক্ষমতা না বাড়লে এ ব্যবধান কমানো যাবে না। এ ক্ষমতা বাড়ানোর একটি পন্থা হচ্ছে ভারতীয় বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করা। আমার আলোচনায় অশুল্ক বাধা, স্ট্যান্ডার্ড সনদ, সীমান্তে টেস্টিং সুবিধা চালু, কাস্টমস কোড সুষমকরণ, সীমান্তে মালপত্র রাখার স্থান বাড়ানো_ এসব প্রসঙ্গও আসে। বাণিজ্য থাকলে বিরোধও স্বাভাবিক। এর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা চাই। সীমান্তে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক সেবা সুবিধা বাড়ানোও এখন সময়ের দাবি।
দুই দেশেরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী অপর দেশে কাজ করছে এবং তাদের একটি অংশের বৈধ অনুমতিপত্র নেই_ এ ধরনের সমস্যা প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। এবারের সংলাপে বিষয়টিকে বৈধতার আবরণে আনতে সাময়িক ওয়ার্ক পারমিট প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
কানেকটিভিটি বারবার আলোচনায় আসছে। ভারত যে ১০০ কোটি ডলার ঋণ অনুদান দিয়েছে, তার সাহায্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উভয় দেশই তার সুফল ভোগ করবে। তবে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়াতে বর্তমান পর্যায়ে রেল ও নৌপথকেই বেশি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সড়কপথের বিদ্যমান সুবিধা এ ক্ষেত্রে অপ্রতুল। ভারতীয়দের দিক থেকে ট্রানজিট ফির বিষয়টি তোলা হয় এভাবে_ যদি পশ্চিম ভারতের পণ্য পূর্ব এবং পূর্ব থেকে পণ্য পশ্চিমে যায়, তাহলে কাস্টম ডিউটি নেওয়ার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু সারচার্জ ও টোল ধার্যে বাধা নেই। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের সেবা গ্রহণ করা হলে তার চার্জ দিতেই হবে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যদি মনে করেন যে, এ ফি তাদের চিকেন করিডোরের পুরনো পথের চেয়ে কম, তাহলে বাংলাদেশের সুবিধা তারা ব্যবহার করবে। অন্যথায় পুরনো পথেই তারা পণ্য আনা-নেওয়া করবে।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত রিভার বেসিন ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। যৌথ নদী কমিশন ও টিপাইমুখ বাঁধের প্রসঙ্গও আসে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের গতি থমকে পড়েছে_ এ অভিমত আমরা দিই। ভারতীয়রা বলছে, চুক্তি না হওয়ার পরও বাংলাদেশের পানির প্রবাহ কমেনি। কিন্তু এটাও অস্বীকারের উপায় নেই যে, এ চুক্তি না হওয়া সম্পর্ক উন্নয়নের পথে মনস্তাত্তি্বক বাধায় পরিণত হয়েছে।
গণমাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান ভারতে না দেখানো এবং ভারতীয় সংবাদপত্র-টেলিভিশনে বাংলাদেশের খবর প্রায় না থাকার প্রসঙ্গ আসে বিশেষভাবে। ভারতের তরফে বিষয়টির সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই_ বরাবরের এ যুক্তিই দেওয়া হয়। আমাদের তরফে বলা হয় যে, সরকারি দূরদর্শন নির্দিষ্ট সময়ে বাংলাদেশের খবরাখবর দেখাতে পারে। সংবাদপত্রেও আরও বেশি খবর পরিবেশন করার সুযোগ রয়েছে। তথ্য বিনিময় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য এবং এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবাই স্বীকার করেন।
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে দু'জন সংসদ সদস্য ছিলেন। সংলাপে ভারতের তিনজন মন্ত্রী এবং একাধিক পার্লামেন্টারিয়ান অংশ নেন। সাবেক স্পিকার পিএন সাংমাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এটা জানা যে, নাগরিক উদ্যোগ যতই থাকুক না কেন, সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আইন প্রণয়ন করতে হয় সংসদ সদস্যদেরই। বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান বিভিন্ন আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে ভারতের একটি দৈনিকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকারের কপি বিতরণ করেন।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের নেতৃত্বে এ প্রতিনিধি দলের সফর দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখবে_ এটাই প্রত্যাশিত। বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগ চলছে।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান :নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ
 

No comments

Powered by Blogger.