সেই চেনা সুর কতদিন শুনিনি by মেহেদী মাসুদ

যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়
যে ছিল হূদয়ের আঙিনায়
সে হারাল কোথায় কোন দূর অজানায়


সেই চেনা মুখ কত দিন দেখিনি
তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি...

নিজের এই গানের মতোই আজ হারিয়ে গেছেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। কোথায় হারালেন? আর কেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন গান থেকে? গত রোববার মুঠোফোনে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। অনেক অনুরোধ করার পর সময় দিলেন আধঘণ্টা। পরদিন সোমবার সকালে, বারিধারায় তাঁর বাসায়।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ তৈরি হয়েই ছিলেন। বসার ঘরে এসে দাঁড়ালেন। এ কোন শাহনাজ রহমতউল্লাহ? মঞ্চে কিংবা টিভিতে যাঁকে সবাই দেখেছেন, সেই চেনা মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনো মিল নেই।
শুরুতেই বললেন, ‘আমি আর গণমাধ্যমের সঙ্গে বসতে চাই না।’
শাহনাজ রহমতউল্লাহর গানের কথা দিয়েই শুরু হলো আলাপচারিতা। বললেন, ‘আমি এখন আর গানের সঙ্গে নেই। অনেকের জীবনেই পরিবর্তন আসে। আমারও এসেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছি, স্বামী-সংসার দেখাশোনা করছি।’
হারমোনিয়ামটার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘হারমোনিয়াম তুলে রেখেছি, তা প্রায় তিন বছর হলো।’
গান গাইতে আপত্তি কোথায়? শাহনাজ রহমতউল্লাহ বললেন, ‘গান গেয়ে আর সবাইকে গান শুনিয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ আর শান্তি পাচ্ছি এখন। অন্য রকম এক তৃপ্তি এখন আমার মনে। স্বামীর (এ বি এম রহমতউল্লাহ) উৎসাহ আর পরামর্শই আমাকে বদলে দিয়েছে।’
একটা বড় সময় ক্লাব, পার্টি, গান—এসব ছিল শাহনাজ রহমতউল্লাহর নিত্যসঙ্গী। সেই শুরু থেকে তাঁকে নিয়ে শোনা যেত নানা খবর। সেই দিনগুলোর কথা উঠতেই তিনি বললেন, ‘ওগুলো ছিল সব বানানো গল্প। গানের জগতেও অনেক রাজনীতি আছে। আমি যেহেতু ওই পথে হাঁটতাম না, তাই আমাকে নিয়ে গল্প হতো প্রচুর। ওসব কখনো গায়ে মাখিনি। তবে একটা কথা বলব, আমি অনেক ভুল করেছি। ভুল পথে হেঁটেছি। এখন অনুশোচনা হয়।’
শাহনাজ রহমতউল্লাহর দুই সন্তান। মেয়ে সিনথিয়া আছেন ইংল্যান্ডে আর ছেলে ফয়সাল কানাডায়।
শ্রোতাদের অভিযোগ—নিজের কণ্ঠের প্রতি সুবিচার করেননি শাহনাজ রহমতউল্লাহ। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমি কিন্তু অসংখ্য গান গেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার বিয়ে হয়। এরপর গানের চেয়ে স্বামী-সন্তান-সংসার আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পায়। একটা গান গাওয়ার জন্য কিংবা টিভিতে অনুষ্ঠান করার জন্য কারও কাছে গিয়ে বসে থাকা আমার স্বভাবে নেই। তাই শ্রোতাদের এমন ধারণা হতেই পারে।’
সম্প্রতি প্রয়াত মেহেদি হাসানের কথা উঠতেই বললেন, ‘আমি তো মেহেদি হাসান সাহেবের শিষ্য।’ আলাপের মধ্যে এল তাঁর ভাই প্রয়াত অভিনেতা জাফর ইকবালের প্রসঙ্গ। মনটা খারাপ হয়ে গেল শাহনাজ রহমতউল্লাহর। বললেন, ‘তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কোনো স্বীকৃতি পাননি। দারুণ মেধাবী ছিলেন। কখনো গান শেখেননি। কিন্তু কী সুন্দর গান করতেন। অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। মৃত্যুর পর তাঁর কবরটাও সংরক্ষণ করা হয়নি।’
স্মরণ করলেন বড় ভাই আনোয়ার পারভেজকে। বললেন, ‘তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মেলোডি কিং। তাঁর সুর করা অনেক গান আমি গেয়েছি। শেষ দিকে খুব অসুস্থ ছিলেন। তাঁরও কোনো মূল্যায়ন হয়নি।’
আধঘণ্টা শেষ হতে চলল। শাহনাজ রহমতউল্লাহ বললেন, ‘আজকের ছেলেমেয়েরা আমার গান করছে। ভবিষ্যতেও করবে। আমার গানই আমাকে সবার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে।’

No comments

Powered by Blogger.