বৌদ্ধ প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ-হামলার ঘটনা তদন্তে নিরপেক্ষ কমিটি চান খালেদা জিয়া

রামু, উখিয়া ও পটিয়ার বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনা তদন্তে উচ্চপর্যায়ের নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গতকাল বুধবার রাতে গুলশানের কার্যালয়ে রামু, উখিয়া ও পটিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করতে এলে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে তিনি এ কথা বলেন।


রাত সাড়ে ৮টায় বৈঠক শুরু হয়ে চলে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে।
খালেদা জিয়া বলেন, সরকার যদি এ ঘটনার সত্যিকার তদন্ত করতে চায়, তবে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করুক। ওই তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এমন অঘটন ঘটানোর সাহস না পায়। তদন্ত চলাকালে কোনো মন্তব্য করা উচিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার যদি এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত না করে, তাহলে আগামী দিনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এর সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা নেবে।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্বস্ত করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, 'চীন সফরের জন্য ঘটনাস্থলে যেতে পারিনি। চীন সফর শেষ করেই আমি সেখানে আসব।' আগামী ১৪ অক্টোবর খালেদা জিয়া ৭ দিনের সফরে চীন যাবেন।
প্রতিনিধিদলের পক্ষে উখিয়ার ভালুকিয়া বৌদ্ধবিহারের সভাপতি দীপক বড়ুয়া ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের চার দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবির মধ্যে আছে, বিরোধীদলীয় নেতার অতিদ্রুত ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ত্রাণ তহবিল গঠন করে দ্রুত সেখানে ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ, ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধদের আইনি সহায়তা প্রদান প্রভৃতি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে রামুর রামকোট বৌদ্ধতীর্থের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো, পটিয়ার খরুলিয়া বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত জ্যোতি বোধি ভিক্ষু প্রমুখ বক্তব্য দেন।
প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো সেদিনের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, 'সেদিন হামলাকারীদের হাত থেকে সম্রাট অশোকের আমলের মূর্তি রক্ষা পেলেও অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে। কী নির্মম ঘটনা ঘটেছে, তা দেখতে আপনি (বিরোধীদলীয় নেতা) আমাদের বৌদ্ধবিহারে আসবেন। আমি আপনাকে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।' তিনি বলেন, 'আমরা বৌদ্ধরা শান্তিতে বিশ্বাসী। আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, সমস্ত জনগোষ্ঠী একই রক্তের মানুষ। তাই বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে দেখলে চলবে না। সম্মিলিতভাবে একে মোকাবিলা করতে হবে। আমি বিরোধীদলীয় নেতাকে অনুরোধ করব, আপনি সেখানে গিয়ে সবাইকে সম্প্রীতিতে বসবাসে অনুরোধ জানাবেন। আমরা চাই, বৌদ্ধ, মুসলমান, হিন্দুসহ সব ধর্মাবলম্বী একসঙ্গে বসবাস করুক।'
বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, 'আমরা আজ অসহায়। আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছি। আমাদের প্রিয় ভূমি আজ ক্ষতবিক্ষত।' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাস্থলে যাওয়ার পরও বৌদ্ধবিহার কিভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হলো, তা নিয়েও ভিক্ষুরা প্রশ্ন তোলেন।
খালেদা জিয়া তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে দুঃখজনক অভিহিত করে বলেন, 'বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সেখানে এ রকম একটি নির্মম ঘটনা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ঘটনার পরপরই আমি বিবৃতি দিয়েছি। একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্তদল গঠন করে সেখানে পাঠিয়েছি।'
বিরোধীদলীয় নেতা রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে দীর্ঘস্থায়ী পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, 'বিএনপি সব সময় আপনাদের পাশে ছিল, এখনো আছে, আগামী দিনেও থাকবে।' খালেদা জিয়া বলেন, 'ইতিমধ্যে আমাদের তদন্তদল তদন্ত শেষে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কাল (বৃহস্পতিবার) তা আমার কাছে জমা দেবে। এরপর গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করা হবে। বিদেশিদের কাছেও এই তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হবে।' বিরোধীদলীয় নেতা বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনায় সরকারের বিশেষ করে প্রশাসনের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
খালেদা বলেন, 'আপনারা (প্রতিনিধিরা) বলেছেন, ঘটনার পরও পুলিশ সেখানে যায়নি। তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই নীরব ভূমিকা পালন সবার কাছে সন্দেহজনক। এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, পুলিশের কেন এই নীরবতা, তা অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ঘটনার পর রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে দোষ চাপানো হয়েছে বিরোধী দলের ওপর। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা বা শীর্ষ পর্যায়ের কারোরই প্র্রকৃত ঘটনা না জেনে কারো ওপর দোষ চাপানো উচিত নয়। তিনি বলেন, 'ওই ঘটনার পর পত্রিকায় কাদের ছবি এসেছে, কারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তা প্রকাশিত হয়েছে। তবে ঘটনা না জেনে কিছু বলা উচিত নয়। এটা প্রকৃত তদন্তে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে আমরা মনে করি।' আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে প্রকৃত অপরাধীরা বেরিয়ে আসবে। সত্য কখনো লুকিয়ে রাখা যাবে না।'
প্রতিনিধিদলে ছিলেন রামুর বৌদ্ধবিহারের বিশুদ্ধবংশ ভিক্ষু, উখিয়ার বৌদ্ধবিহারের কোলিয় বংশ ভিক্ষু, উত্তর বড়বিল বৌদ্ধবিহারের সভাপতি বাবু সেন বড়ুয়া, মরিয়া দীপংকর বৌদ্ধবিহারের সভাপতি বাবু লাল বড়ুয়া, খরুলিয়া ধর্মজ্যোতি বৌদ্ধবিহারের সাধারণ সম্পাদক চন্দন বড়ুয়া, রেজুরকুল বৌদ্ধবিহারের সভাপতি প্রেমানন্দ বড়ুয়া প্রমুখ। আরো উপস্থিত ছিলেন রামুর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, প্রদীপ বড়ুয়া, বিকিরণ বড়ুয়া, মিঠুন বড়ুয়া, কক্সবাজার সদরের কিশোর বড়ুয়া, কানন বড়ুয়া, পরিমল বড়ুয়া, বাবু বড়ুয়া, সুরঞ্জন বড়ুয়া, সুধাংশু বড়ুয়া, খরুলিয়ার আকিঞ্চন বড়ুয়া, লোকনাথ বড়ুয়া, অনঙ্গ বড়ুয়া, কানুনগো বড়ুয়া, টিসেন বড়ুয়া, সুনীল বড়ুয়া, পটিয়ার সুজন বড়ুয়া, বিকাশ বড়ুয়া, প্রদীপ বড়ুয়া, ধনু বড়ুয়া, অমলেন্দু বড়ুয়া, মিন্টু সরদার, রূপক শীল, বিপ্লব চৌধুরী প্রমুখ।
সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, সহসভাপতি সাদেক হোসেন খোকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.