সাক্ষাৎকার-জনগণ আপদ ও বিপদ- দুটিরই বিদায় চায় by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :অমরেশ রায় সমকাল :সিপিবি একটি বড় ও প্রভাবশালী দল ছিল। কিন্তু এখন তো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনাদের দলের প্রাসঙ্গিকতা কী? মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি মাঝে মধ্যে ওঠানামা করেছে, এ কথা ঠিক।


১৯৯৩ সালে সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে বিলোপবাদীরা দলত্যাগ করায় পার্টি কিছু কিছু দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে_ এ কথাও ঠিক। তবে অধিকাংশ সদস্য ও কর্মীই পার্টি ছেড়ে যাননি। পার্টি কেবল টিকে আছে তাই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে গার্মেন্ট শ্রমিক, বস্তিবাসী, রিকশা ও ভ্যান শ্রমিক ইত্যাদি অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের ভেতর এর ভিত্তি প্রসারিত হয়েছে। এ ছাড়া তেল-গ্যাস রক্ষা, গার্মেন্ট ও শনির আখড়ার আন্দোলন ইত্যাদি সাম্প্রতিক সময়ের সব আন্দোলনে সিপিবিকে অগ্রভাগে থাকতে দেখা গেছে। এসব আন্দোলনের ক্ষেত্রে তো বটেই দেশের বুর্জোয়া রাজনীতির দেউলিয়াপনা ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য এবং সর্বোপরি সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের প্রশ্নে সিপিবি ছাড়া আর বেশি প্রাসঙ্গিকতা কারই-বা আছে?
সমকাল :বাম ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে কী কী অন্তরায় আছে বলে মনে করেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :অনেক রকম অন্তরায় রয়েছে। আবার অনেক অনুকূল উপাদানও রয়েছে। অন্তরায়ের চেয়ে অনুকূল উপাদানের পরিমাণ বেশি। নানা ফর্মে বাম ঐক্য তো ইতিমধ্যে আছেই। তেল-গ্যাস রক্ষার সংগ্রাম এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নানা ইস্যুতে কেবল পাশাপাশি থেকেই নয়, এক ব্যানারের নিচে দাঁড়িয়ে বামপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে আসছে। এখন বাকি কেবল এই ঐক্যকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া। সেক্ষেত্রে ডানপন্থি সুবিধাবাদ এবং বাম সংকীর্ণতা যে ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে, তা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সমকাল :বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিপিবির কংগ্রেস কী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :অনেকেই তাকিয়ে আছেন সিপিবির কংগ্রেসের দিকে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল_ এই দুই জোটের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ার যে আওয়াজ সিপিবি তুলেছে, তা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট এবং কী কৌশল সিপিবি নেবে সেটি ওয়াকিবহাল মহলের গভীর আগ্রহের বিষয়। এসব কাজের জন্য কীভাবে সিপিবি তার সাংগঠনিক দায়িত্ব চিহ্নিত করে সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কংগ্রেসে এসব বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হবে।
সমকাল : সিপিবির এবারের কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য কী?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : দেশকে 'আপদ-বিপদ' থেকে মুক্ত করার জন্য দুই জোটের বাইরে বিকল্প বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সমাবেশ ও আন্দোলনের ধারা গড়ে তোলার বিষয়টি এবারের কংগ্রেসের প্রধান এজেন্ডা। সেই লাইন ধরে সিপিবি অনেক দিন চলছে। ইতিমধ্যে বাসদকে সঙ্গে নিয়ে এই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজও শুরু করেছে। অন্যান্য বাম দলকেও এই কাজে টেনে আনার পথ ও পন্থা নিয়ে কংগ্রেসে আলোচনা হবে। তাছাড়াও সব দেশপ্রেমিক উদারবাদী দল, শক্তি ও ব্যক্তিদেরও বিকল্পের ঐক্যবদ্ধ বলয়ে কীভাবে শামিল করা যেতে পারে_ তা নিয়েও কথা হবে।
সমকাল :দুই জোটের বাইরে যে বাম বিকল্প গড়ে তোলার কথা বললেন, সেটি কীভাবে সম্ভব?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :এ জন্য সম্ভব যে এ কাজটি বর্তমানে অবশ্য অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে। দেশ বাঁচাতে বিকল্পের বিকল্প নেই। অনেকেই বিকল্পের কথা বললেও কাজটিতে সেভাবে গা লাগাচ্ছে না। সিপিবি সেই কাজটি করার জন্য কংগ্রেস থেকে বড় রকমের উদ্যোগ শুরু করবে। এ বিষয়ে শিগগিরই অগ্রগতি হবে বলে আমি আশাবাদী।
সমকাল :এবারের কংগ্রেসের মাধ্যমে সিপিবির নেতৃত্বে কোনো পরিবর্তন আসছে কি? তরুণ ও নারী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে আপনাদের ভূমিকা কী হবে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :পার্টিতে তরুণদের নিয়ে আসার জন্য সিপিবি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এবারে কংগ্রেসে ২০ বছর বয়সের নিচের পার্টি সভ্যদের মধ্য থেকে বিশেষ ডেলিগেটস হিসেবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইভাবে নারী কমরেডদের মধ্য থেকেও অতিরিক্ত প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নেতৃত্বেও তার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করা হবে। পার্টির গঠনতন্ত্রে রয়েছে নতুন কমিটিতে পুরনো কমিটির কমরেডদের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি যেন না হয় এবং কমিটিতে যেন এক-তৃতীয়াংশ নারী থাকেন। কংগ্রেসে সেই চেষ্টাই করা হবে। আর কমিটি নির্বাচিত হবে কংগ্রেসে। প্রয়োজনে গোপন ভোটে। এগুলো নিয়ে আগাম কিছু বলার সুযোগ নেই।
সমকাল :দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :এই প্রশ্নটি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে করুন। পর্দার অন্তরালে থেকে তারাই তো রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি কেবল নয়, সামগ্রিক অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক ঘটনাবলিও নিয়ন্ত্রণ করছেন। এমনকি খুঁটিনাটি বিষয়েও তারা নাক গলাচ্ছেন। নির্বাচন হবে কি হবে না, একতরফা হবে না সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে হবে, নির্বাচন হলে কী ধরনের সরকার হবে, অচলাবস্থা দূর হবে কি-না এবং ওয়ান-ইলেভেন আসবে কি আসবে না_ এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। সব অপশনই খোলা রাখা হয়েছে। কে বলতে পারে কী হবে! তাই এ কথা বলা যায় যে, অনিশ্চয়তাই রাজনীতির একমাত্র নিশ্চিত উপাদান।
সমকাল :এর অর্থ কি এই যে, আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের আশঙ্কাও করছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :এ আশঙ্কার কথা কেবল আমারই নয়, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর মুখ থেকেও একাধিকবার উচ্চারিত হয়েছে।
সমকাল : নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনীতিতে উত্তাপ দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :অন্তর্বর্তীকালীন বনাম তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে কেবল বিতর্ক চলছে, তাই নয়। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশটিকে অচলাবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগও দেশি-বিদেশি শাসকশ্রেণী তাদের হাতে রেখে দিয়েছে। অথচ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিলে বিতর্কের প্রয়োজন হতো না। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল হবে, তবে আগামী দুই মেয়াদে এটি চালু থাকবে_ এটিই ছিল আদালতের রায়ের সারবত্তা। এ মুহূর্তে সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধনী আনাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। সংবিধান তো এমনিতেই হাত দিতে হবে। কেননা সংসদ বহাল না রেখে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিতে আদালত সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন।
সমকাল :বর্তমান মহাজোট সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করুন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : মহাজোট সরকার সব প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ। মানুষ এ সরকারকে 'আপদ' মনে করে তাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চায় না। সেটাকে 'বিপদ' মনে করে। জনগণ ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ঝাঁপ দেওয়ার মতো এতটা আহাম্মকও নয়। তারা আপদ ও বিপদ_ দুটিরই বিদায় চায়।
সমকাল :বিরোধী দল তো আন্দোলনের মাঠে রয়েছে। তাদের ভূমিকার মূল্যায়ন করুন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম :আসল বিরোধী দল তো আমরাই। এই সরকারের সাম্রাজ্যবাদ তোষণ, বাজার অর্থনীতির আদর্শ ইত্যাদির ঘোরতর বিরোধী বামপন্থিরাই। বিএনপি তো এক অর্থে আওয়ামী লীগেরই সমমনা দল। তারাও সাম্রাজ্যবাদের তোষণ ও বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধ প্রধানত গদির প্রশ্নে। নীতির প্রশ্নে তাদের বিরোধ সামান্যই। তাই কেউ যদি বিএনপিতে 'দু'নম্বরী বিরোধী দল' বলে তাহলে তা খুব একটা ভুল বলা হবে না।
 

No comments

Powered by Blogger.