কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-নমি তোমায় বন্ধু আমার by রণজিৎ বিশ্বাস

: আপনি যা লেখেন, তা কি সব সময় ছাপা হয়? : হয় না। ইদানীং হচ্ছে না, ছাপবার ছবি পাল্টে গেছে। অবাক হচ্ছি, কেন পাল্টে গেল! : পাল্টে গিয়ে কেমন হয়েছে? কোন ছবিতে তা রূপ নিয়েছে? : যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্য চেয়ে লেখাগুলো কেউ কেউ ছাপাতে চাচ্ছে না।


যারা ছাপবে, তাদের অন্তরলিপি পাল্টে গেছে।
: যুদ্ধাপরাধের বিচার চাওয়া মানে তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষেই কথা বলা, নাকি?!
: অবশ্যই! এর বাইরে আর কী হবে! কী আর হতে পারে।
: আপনি তো কারো নাম ধরেন না। কারো নাম নিয়ে তো আপনি কথা বলেন না।
: না। বলি না। কিন্তু, একটা ব্যতিক্রমী ব্যাপারে আমরা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তসংযুক্ত আছি। আপনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলুন কিংবা বলুন মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শের কথা, তা কিছু লোকের বিরুদ্ধে যাবে, তাদের নাম না নিলেও তারা ক্রুদ্ধ হবে, তারা আপনাকে দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করবে; আপনি যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্য নিয়ে কথা বলুন, কিছু লোক ও তাদের মিত্ররা মাইন্ড করবে। আপনি শিক্ষা, রুচি, সততা, সাধুতা ও নিরপেক্ষতার কথা বলুন, কিছু লোকের তা ভালো লাগবে না। আপনার বলার দরকার নেই, কাদের আপনি চিহ্নিত করতে চাচ্ছেন। সবাই এটি বোঝে, সবাই এদের চেনে। ইস্টারেস্টিং! ভেরি ইন্টারেস্টিং।
: এই কাজগুলো করতে গিয়ে আপনি কখনো বিপদে পড়েছেন?
: পড়েছি। কিছু মানুষ আমার পেছনে লেগেছে, কাউকে কাউকে লাগানো হয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির লোক দেখেছি, ভাড়াটে দেখেছি, আন-গ্রেইটফুল দেখেছি, অশিক্ষিত দেখেছি, অর্ধশিক্ষিত দেখেছি, ঊণশিক্ষিত দেখেছি, অপূর্ণ শিক্ষিত দেখেছি, কুশিক্ষিতও দেখেছি।
: আপনি এর প্রতিবাদ করেননি?!
: করিনি। আমি এই প্রতিবাদের পক্ষে নই। প্রতিবাদের জন্য আমি প্রস্তুতও নই।
: আপনি মুখ বুঁজে সমালোচনা সয়েছেন?! অযৌক্তিক সব সমালোচনা! সওয়া যায় এমন সমালোচনা?!
: সয়েছি তো! বারবার সয়েছি। সইতে হয়, আরও সইব।
: কারণ কী! এমন অবতার তুল্য আচরণের কারণ কী!?
: কারণ দুটো। এক. কোনো কোনো সমালোচনা আছে, প্রতিবাদের লায়েক নয়; কোনো কোনো সমালোচক আছে, ধর্তব্য ভাবার নয়। প্রভুভক্ত একটি প্রাণী আছে, যারা 'বার্ক' করতে অভ্যস্ত। তাদের বাধা দেওয়া বা নিরাশ করা ভালো নয়। আমি আমার গুরুজনদের শিক্ষা অনুযায়ী তাদের ইচ্ছে ও আগ্রহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। আমি তাদের মন ভাঙতে চাই না। কারণ, মানুষের মন ভাঙা ও উপাসনালয় বিচূর্ণ করা একই কথা। দুই. ক্রোধ ও অসূয়ার বশে তারা আমার উপকারই করে। আমার বলায় আমার লেখায় ও আমার আঁকায় মানুষ যা জানতে পারে না, তাঁরা তা ভালোভাবে জানিয়ে দেন; রহস্য ও ইঙ্গিতময়তা যদি কোথাও থেকে থাকে তাঁরা তার আঁশ ও রোয়া আলগা করে দেন এবং পাঠক ও শ্রোতার কাছে নিজেদেরও চিনিয়ে রাখেন।
: এদের মুখোমুখি হলে আপনি কী করেন?
: সর্বোত্তম আচরণ করি, সৌজন্যের চূড়ান্ত দেখাই। যেন কিছুই হয়নি, যেন আমি কিছুই জানি না, কিছুই পড়িনি। আর যদি জেনেও থাকি, এ আর এমন কী! এমন তো হতেই পারে!
: এই নীরবতায় তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয়?
: তারা আরো ক্রুদ্ধ হয়, আরো জ্বলমান হয়, আরো কম্পমান হয়। তারা আরো জ্ঞানশূন্য ও বিবেচনাশূন্য হয়ে যায়। আরো চলমান হয়ে পড়ে।
: আপনি কী করেন? আমি উপভোগ করি, কৌতুক বোধ করি।
: এই লোকগুলো কি খুব উচ্চ শিক্ষিত?
: হ্যাঁ। তেমন আপনি ধরে নিতে পারেন। কেউ কেউ আছেন ভয়াবহভাবে উচ্চ শিক্ষিত। এঁরা অভাবনীয় রকম সংযমী। এঁদের রুচি ও সৌজন্যের তার অনেক উঁচুতে বাঁধা। ওঁরা সব সময় বিবেকের তাড়নায় কথা বলেন। বিদ্বিষ্টভাষণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ওঁরা সইতেই পারেন না। ওঁরা আমাকে মুগ্ধ করেন, বিস্মিত করেন। আমি তাঁদের বলি- নমি তোমায় বন্ধু আমার।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.