তটিনীর পায়ে নূপুর বাঁধার এখনই সময় by শামসুল আরেফিন খান

গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর জলবায়ু উদ্ভট আচরণ করছে। কোথাও দাবদাহ, নজিরবিহীন খরা। কোথাও প্লাবনের এমন তোড় যে তার কোনো প্রাক-দৃষ্টান্ত বা নমুনা মানুষের অভিজ্ঞতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। সুনামি, হারিকেন, প্রবল দাপটের নানা নামের প্রলয়ঙ্করি ধ্বংসলীলাও লণ্ডভণ্ড।


বিভিন্ন উৎসে উদ্গীর্ণ কালো ধোঁয়াই প্রকৃতির এমন হিংস্র আচরণ এবং মানবিক বিপর্যয়ের একমাত্র না হলেও প্রধান কারণ। এমনটাই জানছে সাধারণ মানুষ। বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমে বাড়ছে। তিল তিল করে বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা। নিম্নভূমি প্লাবিত হচ্ছে। নদী সঙ্গমের প্রাবল্য প্রতিহত করে লোনা জল আগ্রাসী হচ্ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ স্থলভূমি সমুদ্রের লোনা জলে তলিয়ে যাবে, এমনটি শুনছি প্রায় ৩০ বছর ধরেই।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। দুর্বিষহ হয়েছে জনজীবন। লাখ লাখ মানুষ এখনই বিপন্ন।
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক সম্প্রতি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নদ-নদীর প্রবহমানতায় হস্তক্ষেপ করে পানি সংরক্ষণের বিষয়টিকে দায়ী করছেন। ওয়াশিংটনের লোকামাস হ্রদে বাঁধ দেওয়ার ফলে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হচ্ছে। গবেষকরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন সেটা এবং আরো ৮০ হাজার বাঁধের ওপর গবেষণা চালিয়েছেন। তার পরই তাঁদের এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে কালো ধোঁয়ার পাশাপাশি অবরুদ্ধ জলধারাও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বিপুল ভূমিকা রাখছে।
এদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যাপক লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার জন্য সে অঞ্চলের নদী-কাঠামোর ওপর দেড় শতাধিক বছরের অন্যায় হস্তক্ষেপকে দায়ী করা হচ্ছে। সে কারণে গঙ্গার মিঠা পানির স্রোতধারার সঙ্গে নদীগুলোর অনেকটারই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। উজানের স্রোতধারা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। লবণাক্ততা প্রতিরোধ করতে গিয়ে পোল্ডার, বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট ও উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করে প্লাবনভূমি থেকে নদীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে জোয়ারে উঠে আসা পলি বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে না পারায় কেবল নদীবক্ষই ভরাট হয়েছে এবং নিম্নভূমিতে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সমগ্র খুলনা-সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার দক্ষিণাংশ, মাগুরা, নড়াইল ও বাগেরহাট জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ হওয়ায় জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। একমাত্র কপোতাক্ষ অববাহিকায় দুই শতাধিক গ্রামের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এই বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। হাজার হাজার হেক্টর তিন ফসলি জমি সারা বছর সাত-আট ফুট পানির নিচে ডুবে থাকছে। বর্ষাকালে শুধু নয়, শীতেও বসতবাড়ি পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। এতদঞ্চলের নদী-কাঠামোর ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ না করলে প্রাকৃতিক ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকত বলে বিশেষজ্ঞরা মত ব্যক্ত করেছেন।
১৮৬১ সালে আসাম বেঙ্গল রেললাইন স্থাপনের সময় থেকেই শুরু হয় সেই সর্বনাশা হস্তক্ষেপ। চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে মাথাভাঙ্গা (চূর্ণী) নদীর শাখা কুমার, নবগঙ্গা, চিত্রা এবং নিম্ন ভৈরবের উৎসমুখে সংকীর্ণ রেলব্রিজ নির্মাণের ফলে বিদ্যমান নদী-কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রমত্তা ভৈরবকে আটকে দিয়ে দর্শনা ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। চূর্ণী ভৈরবের জলপথে যশোর পর্যন্ত ছোট-বড় পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল থেমে যায়। সে দৃশ্যপট ইতিহাসে হারিয়ে গেছে। ১৮৮৯ সালে তাহিরপুরে কপোতাক্ষের উৎসমুখে ১০-১২ কিলোমিটার বিস্তৃত সুউচ্চ বেড়িবাঁধ নির্মাণ সত্ত্বেও যশোর পর্যন্ত ভৈরবের ধারা নিশ্চল হয়ে পড়ে। ১৮৩৮ সালে দর্শনায় ভৈরবের বাঁক ভরাট করে কেরু কম্পানির চিনির কল ও মদের কারখানা স্থাপন করায় মাথাভাঙ্গার সঙ্গে নিম্ন ভৈরবের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এর আগে ১৮৮৩ সালে কলকাতা-খুলনা রেলপথ স্থাপনের সময় যশোরে ইছামতি, বেত্রাবতী, কপোতাক্ষ, হরিহর ও মুক্তেশ্বরীর ওপর অনেক সংকীর্ণ সেতু নির্মিত হয়। যশোর ক্যান্টনমেন্ট তৈরি হয় ১৮৩৮ সালে। সে সময় মুক্তেশ্বরী নদীর তলদেশ ইটের গাঁথুনি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। মুক্তেশ্বরীর উচ্চধারাকে কপোতাক্ষের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। পাহাড়ি স্রোতের মিষ্টি পানি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়ে যশোর এলাকার নদ-নদীগুলো বালুচরে গতি হারাতে শুরু করে। ভরা জোয়ারে লবণপানি দেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে উপর্যুপরি ফসলহানি ও তীব্র খাদ্যাভাব মন্বন্তরের রূপ নেয়। এ সময় দক্ষিণের লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধায় কাতর হয়ে খাদ্যের সন্ধানে উত্তরাঞ্চলের দিকে ছুটতে থাকে। ১৯৫০ সালে দক্ষিণাঞ্চলের মন্বন্তর এবং ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে দেশব্যাপী বন্যার প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের অনুরোধে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে 'ক্রুগ মিশন' নিযুক্ত করে। ক্রুগ মিশনের সুপারিশক্রমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং দক্ষিণের লবণাক্ততা নিরসনের পন্থা হিসেবে নদী অবরোধ নীতি তথা কর্ডনপ্রথা আরোপ করা হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে অবরোধ নীতি বাস্তবায়ন করতে সারা দেশে ১৯৬৭ সালের মধ্যে ৪০০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৭৮২টি স্লুইস গেট ও ৯২টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। একমাত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেই ১৫৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৩৭টি পোল্ডার ৯২ স্লুইসগেট ও উপসাগরীয় বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কর্ডন বা অবরোধ নীতি বাস্তবায়নের ফলে প্লাবনভূমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নদ-নদী থেকে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়ল এবার। নদীবক্ষ আরো স্ফীত হলো সমগ্র পলি মাটি উদরস্থ করে। ক্ষীণ হলো প্রবাহ। এর সরাসরি ও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় নদীপথ সংকুচিত হয়ে বর্তমানে ৩৮০০ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালেও তা ছিল ২৪,১৪০ কিলোমিটার। ১৯৮৪ সালে নৌপথ ছিল আট হাজার ৪৩৫ কিলোমিটার। সেটা ১৯৯২ সালে পাঁচ হাজার ৮৯৬ কিলোমিটারে এসে দাঁড়াল। এভাবে বাংলাদেশের যাত্রী ও মাল পরিবহনের সবটুকু চাপই এসে পড়েছে স্থলপথের দুর্বল অবকাঠামোর ওপর, কিন্তু কোনো সরকারেরই টনক নড়েনি।
বাঁধের অভিজ্ঞতা পরিবেশগত কারণে সুখকর না হওয়ায় ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে বিশাল আকৃতির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো অক্ষত রেখে ছোট আকারের বহু বাঁধ ভেঙে ফেলে নদীগুলোকে শৃঙ্খলমুক্ত করা হয়। সেই সঙ্গে বড় বাঁধগুলোতেও পানি সঞ্চালনের মৌসুমি তারতম্য ঘটিয়ে ভাটি অঞ্চলের পানিপ্রবাহ প্রয়োজন অনুপাতে হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়। সেখানকার নদী খননপ্রক্রিয়া যে নিরন্তর ও নিরবধি, সে কথা বলাই বাহুল্য।
আমাদের দেশের অগণিত নদ-নদীর নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমানতায় অন্যায় হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে দেড় শ বছর আগে। অবরোধ আরোপেরও ৪৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বন্দিদশায় নদী শুধু শীর্ণই হয়নি, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে শুরু করেছে মহামারীর মতো। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে অবরোধ ভেঙে ফেলে নয়, পায়ে মুক্ত ঝরনাধারার মতো নূপুর বেঁধে দিলে প্লাবনভূমি প্রসারিত হয়ে স্থলভূমির উচ্চতা বাড়বে এবং আগ্রাসন স্তিমিত হবে। জলাবদ্ধতায় অবরুদ্ধ মানুষও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
e-mail : muktisakhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.