বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি-অরবিস চক্ষু সেবা প্রকল্প by লিয়াকত আলি

ডায়াবেটিস একটি সারা জীবনের রোগ। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে এবং এ রোগ অসংক্রামক হলেও তা মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের পরিসংখ্যান মতে, পৃথিবীতে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি এবং প্রতিবছর ৬০ লাখ মানুষ এ রোগে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে।


সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এ সংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগই বাস করে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে। পৃথিবীতে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে এবং একই সঙ্গে দুজন নতুন ডায়াবেটিক রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস রোগের ব্যাপকতা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি এবং প্রতিবছর এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। জনসংখ্যার আধিক্য, বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বাংলাদেশে মানুষের জীবনযাত্রা, কাজের ধরন ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে ডায়াবেটিস মহামারি আকারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ডায়াবেটিসজনিত চোখের রোগেরও প্রাদুর্ভাব ঘটছে এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এখন অন্ধত্বের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিজনিত অন্ধত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য নয়। অতএব পূর্ব সচেতনতা, সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার মাধ্যমে এ অন্ধত্বকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসার সুযোগ এখনো অনেক সীমিত। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দক্ষ চিকিৎসকের অভাব, চিকিৎসার সুযোগ না থাকা এবং চিকিৎসার ব্যয়বহুলতা।
অরবিস ইন্টারন্যাশন্যালের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো দেশের উত্তরাঞ্চলে ডায়াবেটিসজনিত চক্ষুসেবায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঠাকুরগাঁও, বগুড়া এবং পাবনা জেলায় স্থানীয় ডায়াবেটিক সমিতির স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির লেজার চিকিৎসাসেবা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসার জন্য রোগ নির্ণয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন, বিদেশ থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, দরিদ্র রোগীদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে এই তিনটি হাসপাতালে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এ পর্যন্ত ১৫০ জনেরও অধিক সেবা প্রদানকারী যেমন- চক্ষু বিশেষজ্ঞ, নার্স, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট, অপটিশিয়ান, কমিউনিটি মবিলাইজারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ হাজার রোগীকে ডায়াবেটিসজনিত চক্ষু রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং ছয় হাজারেরও অধিক রোগীকে লেজার চিকিৎসা ও ছানি অপারেশন করা হয়েছে।
এ প্রকল্পের আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কমিউনিটিতে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ পরিবর্তনের জন্য যোগাযোগ (বিসিসি) কার্যক্রম বাস্তবায়ন। প্রকল্প এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আউটরিচ ক্যাম্প করা, গ্রামে গ্রামে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির ওপর তথ্যচিত্র প্রদর্শন, পথনাটক, আঞ্চলিক গানসহ বিসিসি উপকরণ হিসেবে লিফলেট/পুস্তিকা, ফ্লিপচার্টের মাধ্যমে কাউন্সেলিং, গ্রুপ মিটিং, নিয়মিত বাড়ি পরিদর্শন, উঠান বৈঠক ও ফলোআপ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অরবিস ইন্টারন্যাশন্যালের সহায়তাপ্রাপ্ত এ প্রকল্পের সফলতার ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন, ডায়াবেটিসজনিত চক্ষু রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস (বিআইএইচএস) আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ দুটি বাসের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ চক্ষুসেবা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অরবিস ইন্টারন্যাশন্যালের এ প্রকল্পের সফলতা দেশে ডায়াবেটিসজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় একটি উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আপামর ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য এ উদ্যোগ অপ্রতুল। অরবিস ইন্টারন্যাশন্যাল ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির এ উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, বিআইএইচএস এবং
প্রকল্প সমন্বয়ক, বাডাস-অরবিস চক্ষু সেবা প্রকল্প

No comments

Powered by Blogger.