প্রতিকূল আবহাওয়ায় কোন্ প্রজাতির উদ্ভিদ টিকবে by এনামুল হক

পৃথিবীর জলবায়ু ও আবহাওয়ার যে পরিবর্তন ঘটছে এবং পরিবেশ প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী খরা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। উদ্ভিজ গর্ভের প্রতি বিরাট চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। এর ফলে কিছু কিছু উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানী মহলের আশঙ্কা।


লসএ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক গবেষণা চালিয়েছেন যার সাহায্য ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে কোন কোন প্রজাতির উদ্ভিদ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রতিকূল আবহাওয়ায় কোন কোন প্রজাতির উদ্ভিদ সবচেয়ে বেশি বিপন্ন এবং তার পূর্বাভাস কিভাবে দেয়া যেতে পারে এ নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে এক শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিতর্ক চলে আসছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক লরেন ম্যাক ও তাঁর দল এ ব্যাপারে গবেষণা চালিয়ে একটা মৌলিক বিষয় আবিষ্কার করেছেন আর এর মধ্য দিয়ে এই বিতর্কের অবসান হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও উদ্ভিদ কিভাবে পুরা সহ্য করতে পারবে সে সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার সুযোগ সৃষ্ট হয়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে উদ্ভিজগতের প্রতি যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ।
মাটি শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কেন সূর্যমুখী ফুল নেতিয়ে যায় ও দ্রুত ঝরে পড়ে অথচ ক্যালিফোর্নিয়ায় চ্যাপারাল নামে স্থানীয় গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ কেন সুদীর্ঘ শুষ্ক মৌসুমেও টিকে থাকে এবং এর পাতাগুলোও থাকে চিরসবুজ উদ্ভিদের খরা সহনশীলতা নির্ণয়ের নানান পদ্ধতি বা বৈশিষ্ট্য আছে। তার মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে জোর বিতর্ক চলছে। লরেন ম্যাকের নেতৃত্বাধীন গবেষক দলটি যে বৈশিষ্ট্যের ওপর মূল দৃষ্টি নিবন্ধ করেন সেটিকে বলা হয় টারগার লস পয়েন্ট। অর্থাৎ জল বা রসসিক্ত উদ্ভিদের কাঠিন্য ভাব যে বিন্দু থেকে হ্রাস পেতে শুরু করে। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের খরা সহিষ্ণুতার পূর্বাভাস এর সাহায্য যে দেয়া যেতে পারে তা আগে কখনও প্রমাণিত হয়নি।
উদ্ভিদ ও জীবজগতের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য হলো উদ্ভিদের কোষগুলো কোষ প্রাচীরের দ্বারা অবরুদ্ধ। কিন্তু প্রাণীদের কোষগুলো তা নয়। উদ্ভিদ তার কোষগুলোকে সচল ও ক্রিয়াশীল রাখার জন্য ‘টারগর প্রেসার’ এর ওপর নির্ভর করে। টারগর প্রেসার হলো এক ধরনের চাপ। উদ্ভিদের কোষের ভেতর এই চাপ তৈরি হয়। অভ্যন্তরীণ লোনা পানি কোষ প্রাচীরকে ঠেলে ধরে খাড়া করে রেখে এই চাপ সৃষ্টি করে উদ্ভিদের পল্লব বা পাতা আলোক সংশ্লেষণের উদ্দেশ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণ করার জন্য যখন তাদের রন্ধ্রগুলোর মুখ খুলে দেয় তখন বাষ্পায়িত হয়ে উঠে গিয়ে এই পানি যথেষ্টে পরিমাণে কমে আসে। এতে কোষগুলোতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তার ফলে তারল্যের চাপ কমে আসে। খরার সময় কোষের পানিশূন্যতা দূর করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ‘টারগর লস পয়েন্টে’ পৌঁছা বা তারল্যের চাপ হারিয়ে ফেলা তখনই হয় যখন পাতার কোষপ্রাচীরগুলো কাঠিন্য হারিয়ে নরম তুলতুলে হয়ে পড়ে। কোষপর্যায়ে এই তারল্য চাপ হারানোর ফলে পাতা নিস্তেজ হয়ে শুকিয়ে যায়। ফলে উদ্ভিদের আর পরিবৃদ্ধি হয় না। ম্যাক বলেন, মাটি শুষ্ক হয়ে পড়লে উদ্ভিদের কোষগুলো তারল্যের চাপ হরিয়ে ফেলে। উদ্ভিদের সামনে তখন দুটো পথ খোলা থাকে। এক পাতার স্টোমাটা বা রন্ধ্রগুলো বন্ধ করে দিয়ে অনাহারের ঝুঁকি নেয়া নয়ত দুই, নেতিয়ে পড়া পাতাগুলোর সাহায্যে আলোক সংশ্লেষণ চালিয়ে পাওয়া এবং এইভাবে তার কোষ প্রাচীরগুলো ও মেটাবলিক প্রোটিনের ক্ষতিসাধণের ঝুঁকি নেওয়া। অধিকতর খরা সহিষ্ণু হতে হলে উদ্ভিদের প্রয়োজন তার তারল্যের চাপ হারিয়ে ফেলার বিন্দুর পরিবর্তন ঘটানো যাতে করে মাটি শুষ্ক থাকলেও উদ্ভিদ কোষগুলো তাদের তারল্যের চাপ ধরে রাখতে পারে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ সহকারে দেখিয়েছেন যে, যেসব উদ্ভিদ অধিক খরাসহিষ্ণু সেগুলোর তারল্যের চাপ কম হ্রাস পায়। মাটি শুকনো থাকলেই সেগুলোর তারল্যের চাপ অক্ষুণœ থাকে।
উদ্ভিদের যেসব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা তারল্য চাপের ক্ষমতা ও খরাসহিষ্ণুতা নির্ধারিত হয় বলে অনেক বিজ্ঞানীর দীর্ঘদিনের ধারণা গবেষক দল সেটি নাকচ করে দিয়ে বাড়তি একটি বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন। ধারণা করা হতো যে, উদ্ভিদ কোষের দুটি বৈশিষ্ট্য তারল্যের চাপকে প্রভাবিত করতে ও খরা সহিষ্ণুতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। সেগুলো হলো এই যে, উদ্ভিদ তার কোষ প্রাচীরগুলোকে আরও বেশি কঠিন করে তুলতে পারে অথবা গলে যাওয়া দ্রবণে পূর্ণ করে তাদের কোষগুলোকে আরও লবণাক্ত করতে পারে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অনেকের কাছে কঠিন কোষ প্রাচীরের ব্যাখ্যাটি বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কঠিন কোষপ্রাচীরের কারণেই গাছের পাতা শুকনো মৌসুষে শুকিয়ে যায় না এবং পানি ধারণ করে রাখতে পারে।
বিজ্ঞানী মহলের সারাবিশ্বের উদ্ভিদের কোষগুলোর লোনাভাব সম্পর্কে তেমন একটা জানা ছিল না। অথচ ক্যালিফোর্নিয়ার এই গবেষক দলটি আজ অকাট্যভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের যে খরাসহিষ্ণুতা রয়েছে তার কারণ সেগুলোর কোষের প্রাণবসের লবণাক্ততা বা লোনাভাব। প্রত্যেক উদ্ভিদের কোষের প্রাণরসের এই লোনাভাবের জন্যই উদ্ভিদের পক্ষে শুকনো মৌসুমে তারল্যের চাপ বজায় রাখা এবং খরা দেখা দিলে আলোকসংশ্লেষণ ও শারীরিক বৃদ্ধি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কোষ প্রাচারের কাঠিন্য পাতার সতেজভাব হারিয়ে শুকিয়ে যাওয়া রোধ করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে না। তবে পরোক্ষ সুবিধা যোগাতে পারে যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যেমন কোষগুলোর অত্যধিক শুকিয়ে আসা রোধ করা ইত্যাদি। গবেষক দলটি প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী খরাসহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত উপাত্ত সংগ্রহ করে তার মধ্য দিয়ে তাদের গবেষণার ফলাফল সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। দেখা যায় যে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের খরা সহিষ্ণুতার সঙ্গে কোষের প্রাণরসের লোনাভাবের একটা যোগসূত্র আছে, কোষ প্রাচীরের কাঠিন্যের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বস্তুত যেসব প্রজাতির উদ্ভিদের কোষ প্রাচীরের কাঠিন্যভাব আছে সেগুলো শুধু উষর অঞ্চলেই নয়, বৃষ্টিবিধৌত চরাঞ্চলের মতো স্যাঁতস্যাঁতে অঞ্চলেও দেখা যায়।
ম্যাক বলেন, কোষের প্রাণরসের লোনাভাবই উদ্ভিদর খরাসহিষ্ণুতার প্রধান চালিকাশক্তি এটা সুনির্দিষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়ার ফলে বড় ধরনের বিতর্কের অবসান হয়েছে এবং কোন কোন প্রজাতির উদ্ভিদ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ক্রিস্টিন স্কোফনি বলেন, কোষগুলোতে ঘনীভূত লবণ আরও আটসাঁটোভাবে পানি ধারণ করতে সাহায্য করে এবং খরার সময় উদ্ভিদকে তারল্যের চাপ বজায় রাখার সুযোগ করে দেয়। কঠিন কোষ প্রাচীরের ভূমিকাটি ছলনাময়। গবেষক দলের অপর সদস্য মেগান বার্টলেট বলেন : ‘আমরা অবাক হলে লক্ষ্য করেছি যে, কঠিন শেষ প্রাচীর থাকলে বরং খরাসহিষ্ণুতা সামান্য মাত্রায় কমে আসে, যা প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী। তবে ঘনীভূত অবস্থায় প্রচুর পরিমাণ লবণ আছে এমন অনেক খরাসহিষ্ণু উদ্ভিদেরও কঠিন কোষ প্রাচীর রয়েছে। গবেষকরা বলেন, এই আপত স্ববিরোধিতার ব্যাখ্যা হলো এই যে, তারল্যের চাপ হারানোর কারণে পানিশূন্যতায় পাওয়া কোষগুলোকে লুকিয়ে আসার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য খরাসহিষ্ণু উদ্ভিদের গৌণ প্রয়োজন হলো কোষ প্রাচীরের কাঠিন্য ধরে রাখা। কোষ প্রাচীরের কাঠিন্য কোষের তারল্য চাপ বজায় রাখে না। তবে তারল্য চাপ কমার সময় কোষগুলোর সংকোচন রোধ করে এবং পানি ধারণ করে রাখে।
বালেটের মতে, উদ্ভিদের জন্য একটা আদর্শ ব্যবস্থা হলো দুটো বৈশিষ্ট্যই একত্রে থাকা। অর্থাৎ তারল্যের চাপ বজায় রাখার জন্য উচ্চমাত্রায় লবণের দ্রবণের সমাবেশ থাকা এবং খুব বেশি পানি হারানো এবং কোষের সঙ্কোচন রোধ করার জন্য কোষপ্রাচীরের কাঠিন্য রক্ষা করা। তবে খরা সংবেদনশীল উদ্ভিদেরও অনেক সময় পুরু কোষপ্রাচীর থাকে। কারণ শক্ত পাতা ও তৃণভোজীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা উত্তম উপায়।
সুতরাং গবেষক দলটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারল্যের চাপ ও কোষের লোনা প্রাণরসের উপস্থিতি দেখে একটা উদ্ভিদের খরা সহনশীলতার ভবিষ্যত সম্পর্কে জোর পূর্বাভাস দেয়া যায়। কিন্তু তারপরও মরুভূমির কিছু কিছু অতি বিখ্যাত ও বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ আছে এমন ক্যাকটি ইউকাস ও আগাতেস এগুলোর আচরণ ঠিক বিপরীত। এগুলোর অনেক নরম।

No comments

Powered by Blogger.