অর্থনীতিতে দুর্বৃত্ত কোম্পানিগুলোর ‘অবদান’-এর দরকার আছে কী? by ড. আর এম দেবনাথ

ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা। তখন কিছুদিনের জন্য কলকাতায় ছিলাম। যেখানেই যাই শুনি একটা নামকরা কোম্পানির কথা। তারা সাধারণ মানুষের অফুরন্ত উপকারে আসছে। তাদের কাছে টাকা রাখলে তারা উচ্চহারে সুদ দেয়। ব্যাংক যেখানে দেয় এক টাকা সেখানে তারা দেয় দুই টাকা।


টাকার কোন মার নেই। মাসের নির্দিষ্ট দিনে কোম্পানির কর্মচারীরা টাকা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়। আবার কেউ টাকা জমা দিতে চাইলেও কোম্পানির কর্মচারীরা বাড়ি থেকে সেই টাকা সংগ্রহ করে আনে। কোন ব্যতিক্রম নেই। দেখলাম মধ্যবিত্ত, অবসরভোগী, মা-মাসীমা থেকে শুরু করে শ্রমজীবী মানুষ পর্যন্ত এই কোম্পানির নামে পাগল। এত ভাল কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গে আর হয়নি। ছোট ছোট ‘ফান্ড’ সংগ্রহ করে তারা বড় হচ্ছে। লোকের মুখে মুখে প্রশংসা শুনে মানুষ তাদের সঞ্চয় ঐ কোম্পানিতে রাখা শুরু করে। অবসরভোগীরা তাদের পেনশনের টাকা ঐ কোম্পানিতে রাখছে। একজন আরেক জনকে প্রলুব্ধ করছে। বাড়িতে বাড়িতে, পাড়ায় পাড়ায় ছেলে-মেয়েরা যাচ্ছে। এরা বেকার ছেলেমেয়ে। কমিশনের ভিত্তিতে কাজ করে। অল্পতেই তারা তুষ্ট। অবশ্য তখন কলকাতাও ছিল সস্তা। এক-দুই টাকা হলে দুপুরের খাবার হয়। দশ পয়সা, কুড়ি পয়সা বাস ভাড়া, ট্রাম ভাড়া। বনগাঁও থেকে শিয়ালদহের ট্রেন ভাড়া চার কী পাঁচ টাকা। শিয়ালদহ-বারাকপুরের ট্রেন ভাড়া এক টাকা। এমন সস্তার বাজারে বেকার ছেলেমেয়েরা মাসে ৫০-১০০ টাকা রোজগার করতে পারলেই মহাখুশি। এরা অল্প পয়সায় কোম্পানিটির দারুণ সুহৃদ হিসাবে কাজ করে। তখন বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রী ড. অশোক মিত্র। ‘সঞ্চয়িতা’ নামীয় এই চমকপ্রদ কোম্পানির চমকপ্রদ ব্যবসা দেখে তার সন্দেহ হয়। তিনি এর আদ্যোপান্তের খবর নেয়া শুরু করেন। আমারও ইন্টারেস্ট বাড়ল, সত্যিই তো এই কোম্পানি কী করে তখনকার সময়ে ২০-২৫ শতাংশ হারে সুদ দেয়! দেখা গেল কোম্পানির কোন হিসাবপত্র নেই। টাকা কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না। কোথায় তাদের বিনিয়োগ, সেই বিনিয়োগ থেকে কত তাদের আয় এর কোন খবরই নেই। শেষ পর্যন্ত মুম্বাই তখনকার বোম্বেতে একটা না দুইটা ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেল। মাঝখান থেকে তখনকার সময়ের ভারতীয় ৫০০-৬০০ কোটি রুপী লোপাট হয়ে গেল। লাখ লাখ লোক সর্বস্বান্ত হয়। এরা করত কী? প্রতিদিন নতুন যে টাকা জমা হতো এর একটা অংশ দিয়ে মানুষকে সুদের টাকা দিত, বাকি টাকা মেরে দিত। শেষ পর্যন্ত যতদূর মনে পড়ে এই কোম্পানির দুইজন পরিচালক আত্মহত্যা করে।
এতসব কথা কেন? এতসব কথা আমাদের দেশের এক শ্রেণীর লোক ও কোম্পানির লুটপাট দেখে। আমার কলকাতায় থাকার সময়ে মনে করতাম যাক, বাংলাদেশে অন্তত এত বড় ‘ফ্রড’ নেই। এখন দেখছি ‘ফ্রড’ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী! কিভাবে এক শ্রেণীর দামী দামী লোক, প্রভাবশালী লোক দিব্যি টাকা কামাই করে সব লোপাট করে দিচ্ছে। জমি দখল, নদী দখল খালবিল দখল, পাহাড়-পর্বত দখল, সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখল, খাসজমি দখল ইত্যাদির কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে ‘ক্যাশ’ টাকা মেরে দেয়ার। বছরখানেক আগে, বলা যায়, আইনের ফাঁকফোকরে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী শেয়ার ব্যবসায়ী, শেয়ারে বিনিয়োগ কারী, কোম্পানির পরিচালক-মালিক বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত সেই ধকল শেয়ারবাজার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম গত দুই বছরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে।। বিচারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কবে তা শুরু হবে তা কেউ জানে না। কিছুদিন আগে ‘যুবক’ নামে একটি প্রকল্প বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে হঠাৎ ব্যাংক বীমা কোম্পানির মালিক হয়ে যায়। গার্মেন্টস, ওষুধ শিল্পসহ সবকিছুতে তারা হাত দেয়। কে এই কোম্পানির মালিক, খবর কর। দেখা গেল সামনে সব অজ্ঞাত লোক। কিন্তু পেছনে প্রভাবশালীরা যাদের সাহায্য সমর্থন ও সহযোগিতায় ‘যুবক’ লুটপাট চালায়। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। কিন্তু কারও কী কোন বিচার হয়েছে? হাজার হাজার কোটি টাকার কী কোন খবর আছে? প্রতারিত লোকেরা কেমন আছে- কেউ আমরা জানিনা। কয়েকদিন আগে শুনলাম ‘ডেস্টিনির’ কথা।
আজ থেকে বছরখানেক আগের কথা। বিজয়নগরের মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি রাস্তা ক্রস করব বলে। দেখি পাশের বিল্ডিং-এ ‘ডেস্টিনি’র অফিস। ডজন ডজন ছেলেমেয়ে ভাল ভাল পোশাক পরা। এরা সবাই ডেস্টিনির কর্মচারী বলে মনে হলো। একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কী ব্যবসা কর ভাই?’ ছেলেটি যে জওয়াব দিল আমি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কেন জানি মনে হচ্ছিল এটা হচ্ছে ‘স্বপ্ন বিক্রির’ ব্যবসা। যাহা বলেছি, দুটো ছেলে পারলে আমাকে ধরে ফেলে। বলে কী! আপনি চাকরি দেবেন? উপকার করার লোক নেই খালি সমালোচনা। আমি আর কথা বাড়ালাম না। মনে মনে ধরে নিলাম একদিন না একদিন তারা ধরা খাবে। যখন শুনলাম একজন বিখ্যাত ব্যক্তি এর সাথে জড়িত তখন ভয় পেয়ে গেলাম। তাহলে হয়ত বিচার আচার কিছুই হবে না। এখন দেখা যাচ্ছে সরকার/দুদক কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। কাগজে দেখলাম ২২ জনের বিরুদ্ধে ‘দুদক’ মামলা করেছে। এর মধ্যে ডেস্টিনির এমডি সাহেব যেমন আছেন তেমনি আছেন প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান লে: জে: (অব) হারুন-অর রশিদ। যতদূর জানি তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। এদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে। কত টাকা তসরুফ? ৩,২৮৫ কোটি টাকা অত্মসাত করেছে এই আসামিরা। মামলাটি হয়েছে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন’ আইনে। দুটো মামলা এক সঙ্গে। ভাবা যায় কয়েক জন ব্যক্তি এত অল্প সময়ের মধ্যে ৩,২৮৫ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। এরাই আবার কিছুদিন আগে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে যে তারা দেশের ‘জিডিপি’তে অবদান রাখছে। হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছে। সরকারকে বহু টাকা কর দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ধরনের বিজ্ঞাপন যতদূর মনে পড়ে। ‘যুবক’ও দিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে ‘ফ্রড’রা যখনই কোন বিপদে আপদে পড়ে তখনই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় এবং বলে তারা দেশের ‘সেবা’ করছে। গত ২০-৩০ বছরে এ ধরনের বহু বিজ্ঞাপন দেখেছি। গত সপ্তাহে দেখলাম ‘হলমার্কের বিজ্ঞাপন। কে এই হলমার্ক? এরা কোন নামী দামী প্রতিষ্ঠান নয়। দেশের কত বড় বড় ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’ আছে। সোনালী ব্যাংকের জালিয়াতির কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম কয়েকটি কোম্পানির নাম। ভেবেছিলাম ‘রূপসী বাংলা’ শাখার সোনালী ব্যাংকের জালিয়াতিও নিশ্চয়ই বড় কোন কোম্পানি বা গ্রুপ করেছে। পরে দেখলাম, না, এমন একটি প্রতিষ্ঠান করেছে যাকে কেউ চেনেই না। কে এই হলমার্ক যারা ভুয়া এলসি খুলে সরকারী চার ব্যাংকের ৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছে? এরা কী হলমার্কের এমডি ও জিএম, এরা কী ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা? আমি নিশ্চিত এত বড় ঘটনা এই সামান্য কয়জন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী করতে সাহস পায়নি। এর পেছনে রয়েছে বহু প্রভাবশালী লোক যাদের নাম আমরা হয়ত কোনদিন জানতে পারব না। জানতে পারি আর না পারি একটা কথা জানলাম যে ব্যাংকের টাকা আত্মসাত হয়েছে। ৬ হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায়? এটা করা হয়েছে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে যা ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ করে দেখা যাচ্ছে বলা হচ্ছে অবদানের কথা। হলমার্ক বলছে তারা লোকের চাকরি দিয়েছে, সরকারকে কর দিয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এখানেই আমার কথা। সময় হয়েছে বলার যে দুর্বৃত্তদের ‘অবদানের’ দরকার নেই। দেশের টাকা, ব্যাংকের টাকা লুট করা হবে, খাস জমি দখল করা হবে আর সরকার ধরলেই বলা হবে অর্থনীতিতে অবদান রাখা হচ্ছে। এই সমস্ত দুর্বৃত্তকে বলা দরকারÑ অবদান রাখতে হবে আইনের অধীনে। ব্যবসা শিল্প আমদানি রফতানি এ সবই করতে হবে আইনের অধীনে। বলতে হবে টাকা বানাতে হবে আইন মেনে, নিয়ম মেনে। নিয়ম ভেঙ্গে আইন ভেঙ্গে টাকা বানানো দ-নীয় অপরাধ। এই কথাটি সরকারকে প্রমাণ করতে হবে। দুর্ব্ত্তৃরা সরকারকে দুর্বল ভাবছে। দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশকে ‘ফ্রি ফর অল’ মনে করছে। এই ধারণা ভুল প্রমাণ করতে হবে। আশা করি দুদক ‘ডেস্টিনির’ মামলায়, সোনালী ব্যাংকের মামলায় এই কথাটা প্রমাণ করতে পারবে।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.