নারীর কথা by অজয় কুমার রায়

৮ মার্চ ১৯৯৭। সরকার প্রথবারের মতো সর্বস্তরে নারী ও পুরুষের সমানাধিকার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেন। নারী উন্নয়ন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলেও বর্তমান সময়ের নারীদের যে ভাবমূর্তি, তা বিশ্ব ইতোমধ্যে দেখেছে। বাংলাদেশের নারীরা কোনক্ষেত্রেই কম নয়।
যেমন রাষ্ট্র পরিচালনা, নেতৃত্ব, এভারেস্ট জয় এমনকি কর্মক্ষেত্রে কম ভূমিকা রাখে না। সর্বক্ষেত্রেই নারী তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছে পুরুষের পাশাপাশি। সামাজিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝা যায় যে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা, বৈষম্য ও নিপীড়নের মধ্যে রেখে একটি দেশ কখনই এগোতে পারবে না। বিশ্বের বহু মুসলিম দেশ সিডও অনুমোদন করেছে। বস্তুত নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা কখনই ভাল কাজ হতে পারে না। এখনও অনেকে বলে থাকে জাতীয় জীবনে নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নারীকে দিতে হবে ন্যায্য অধিকার।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি নিয়ে বিষয়বস্তুকে একটু এগিয়ে নেয়া যাক।
১৪ ধারায় উল্লেখ আছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে, মেহনতি মানুষ, কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।
১৫ ধারায়, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশীল ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রায় বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন করা যায়।
(ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।
(খ) কর্মের অধিকার। অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার।
২৮ (১) এ অনুচ্ছেদে উল্লেখ অনুযায়ী, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ-নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।
২৮ (২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ অনুযায়ী, রাষ্ট্র ও গণজীবনে সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।
সংবিধানের ধারাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমঅধিকার এবং নারীর পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার অধিকার নিয়ে কোন রকম বিতর্ক থাকতে পারে না। সংবিধান সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখার শপদ নিয়ে যে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র ও সরকারি ক্ষমতা গ্রহণ করেন তাদের নারীনীতি উন্নয়ন সাংবিধানিক নিয়মানুসারে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ সাংবিধানিক দায়িত্ব। অথচ এদেশের সাধারণ মানুষ দেখেছে, ২০০৪-এ চার দলীয় জোট সরকার, ’৯৭-এর নারীনীতির ওপর কাঁচি চালায় এবং থমকে দেয় নারী উন্নয়নের গতিধারা। ’৯৭-এর নারী নীতি সুপারিশমালায় ৯ অনুচ্ছেদের ২ উপঅনুচ্ছেদে ছিল বাংলাদেশের দুতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রদুতসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, পরিকল্পনা কমিশনসহ বিচার বিভাগের উচ্চ পদে নারী নিয়োগ প্রদান করা। কিন্তু ২০০৪-এ নারীনীতি উন্নয়নে এই উপঅনুচ্ছেদটি সম্পূর্ণ বাদ দেয়া হয়েছিল। যেটা ২০০৮ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তন করে নারীনীতি উন্নয়ন-২০০৮ ঘোষণা করেন। তখন অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, নারীর সমঅধিকার, অংশদারিত্বকেন্দ্রিক ও উত্তরাধিকারের ইতিহাস। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ইন্দোনেশিয়ার সংসদে ১১ শতাংশের বেশি নারী। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের মনোনয়নের অন্তত ৩০ শতাংশ নারী প্রার্থী বাধ্যতামূলক। মিসরের এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে স্বামীর চেয়ে স্ত্রীরা বেশি উপার্জন করে এবং ছেলেমেয়ে মানুষ করার ক্ষেত্রে সমান ভূমিকা রাখে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ভাই স্বেচ্ছায় বোনকে সমান ভাগ দেয়। মরক্কোয় ২০০৪ সালে গৃহীত পারিবারিক আইনে বিধিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত পেয়েছে।
পিছনের ইতিহাস আমাদের আরও সামনের দিকে অগ্রসর হতে অনুপ্রেরণা যোগাবে, নারীরা যুগে যুগে নির্যাতিত হওয়ার পরও থেমে থাকেনি। শত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে নারীরা যেমন থেমে থাকেনি-আজও থাকে না আগামীতে থাকবে না। তেমনি উদাহরণ আমাদের নারী সমাজের মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি নারীদের উদ্দেশ্যে ও পুরুষশাসিত সমাজকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলেছেন, গাড়ির দুটো চাকার একটা ছোট হলে, সে গাড়ি সামনের দিকে যায় না, এক জায়গাতেই ঘুরপাক খেতে থাকে। আমাদের দেশ এবং সমাজকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাইলে শিক্ষা এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো সুহৃত নারীর পাশে না এলে আজও আমাদের মৌলবাদীরা তরতাজা বধূটিকে বাধ্য করতো আত্মাহুতি দিতে। অন্ধ বিশ্বাস নারীকে শুধুই নির্যাতনই করেনি, নারীকে আবদ্ধ রেখে কষ্টের যাঁতাকলে করেছে পিষ্ঠ।
বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ২৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি নারী নিয়োজিত প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পেশায়। প্রায় ৮৬ শতাংশ নারী কাজ করে মৎস্য বনায়নসহ কৃষি খাতে, ১০ শতাংশ নারী কাজ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিবহন খাতে, ৩ শতাংশ নারী বিপণন শ্রমিক। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ এবং শহরকেন্দ্রিক শ্রমনির্ভর শিল্পে অর্থাৎ পোশাক শিল্পে ৮৫ শতাংশই হচ্ছে নারী। অথচ আমাদের দেশে দুটো প্রবাদ প্রচলিত আছে। যেমন নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে বলা হয় নারী মায়ের জাত এবং সেই নারীর প্রতি করুণা করে বলা হয় মেয়ে মানুষ পরের ভাগ্যে খায়।
আজ যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে আটকে রাখতে চায় তারাই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বলেছিল হিন্দু ও যুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নারীরা গনিমতের মাল। পাকিস্তানই হানাদার বাহিনী তাদের ভোগ করতে পারবে। যারা ধর্মকে এভাবে ব্যবহার করতে পারে তারা আসলে সমাজ ও জাতির বিষবৃক্ষ।
বর্তমান নারী সমাজ মৌলবাদীদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করে উন্নতির সোপানে পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসে। যা দেখে কিছুদিন পূর্বে আমেরিকার বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মজিনা স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের নারীদের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। তারা মহীয়সী বেগম রোকেয়ার মতো আগুনের শিখা হয়ে জ্বলে উঠছে, পুরুষের পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেছে। শুধু কর্মক্ষেত্রে নয় সংসারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ও লালন পালন করার ক্ষেত্রে নারীরাই বেশি ভূমিকা রাখছে। যদিও নারীদের পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নির্যাতন থেমে নেই। কিন্তু স্বীকার করতে হবে পূর্বের তুলনায় নারীদের উন্নতি আগামী পথের আলোর দিশারি হয়ে সমাজটাকে বদলে দিচ্ছে। অতএব বাংলাদেশেই শুধু নয়, বিশ্বের যে কোন দেশে শান্তি উন্নয়ন প্রগতির পথে অগ্রসর হতে হলে নারীকে গৃহবন্দী না রেখে তার সমঅধিকার ও সমমর্যাদা দিতে হবে। আর আমাদের সমাজকে অবশ্যই নারীর অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। তবেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.